অধ্যক্ষ থেকে দারোয়ানের কাছে জিম্মি ভিকারুননিসার ছাত্রীরা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দারোয়ান থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত ছাত্রী ও অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন। এ কারণে এক ধরনের জিম্মি অবস্থায় থাকতে হয় ছাত্রীদের। ভর্তি বাণিজ্য আর কোচিং বাণিজ্যের মহারাজ্য গড়ে উঠেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব কারণে গত ১৪ বছর থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয় না! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা উঠে এসেছে। বুধবার এ প্রতিবেদন শিক্ষামন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছে তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি আত্মহত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে অরিত্রি অধিকারী ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রী ও অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়। শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র কারণে অকারণে ছাত্রীদের টিসি দিয়ে বের করে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে গেটের দারোয়ান ও পিয়নসহ সকলেই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। এসব ব্যাপারে ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। গিনিপিগ হয়ে সকলেই নীরবে সয়ে যান। একই কারণে ২০১২ সালেও ১৮ ফেব্রুয়ারি চৈতি রায় নামে ৯ম শ্রেণির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০৪ সালে হামিদা আলী নামে একজন অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে আর অধ্যক্ষ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ও গভর্নিং বডির স্বার্থ উদ্ধারে ভর্তি বাণিজ্য ও নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ না দিয়ে তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বসিয়ে রাখছে।
এভাবে ১৪ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। বর্তমানে নানজীন ফেরদৌস নামে যাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তিনি এ পদের জন্য অযোগ্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার জন্য স্কুল শিক্ষকরা প্ররোচনা দিয়েছেন। তার সামনে বাবা-মাকে অসহনীয় অপমান আর টিসি দেয়ার কষ্ট সইতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী অনৈতিক বা অন্যায় কিছু করলে তা কমিটি করে খতিয়ে দেখা হয়। এরপর অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। ফাঁসির আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়, কিন্তু অরিত্রিকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং তাকে ও তার অভিভাবককে চরমভাবে অপমান-অপদস্থ করা হয়েছে। এই বেদনা নিয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
তিনি আরও বলে, শিক্ষকরা আইন-কানুন না মেনে ইচ্ছামতো চলে। অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠান প্রধানের চেয়ারে বসিয়ে চলে শিক্ষকদের অন্যায়-অত্যাচার! অরিত্রির ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ তিন শিক্ষক আত্মহত্যার জন্য প্ররোচনা দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বুধবার এ প্রতিবেদন শিক্ষামন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে রাতে জরুরি বৈঠক করে অপরাধী অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিনাত আক্তার ও শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা তদন্তে ৩ ডিসেম্বর রাতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়।