অভিভাবকই পারেন সন্তানকে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে!!!
ড. আব্দুস সাত্তার, ওয়াশিংটন ডিসি:
বাবা-মার উদাসীন মনোভাব সন্তানকে বিপথগামী করে তুলছে। সন্তানকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে অভিভাবককে যা করা প্রয়োজনঃ সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে তার প্রতি খেয়াল রাখা, চলার ক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া। সন্তানের সাফল্যে যেমন প্রশংসা করবে, তেমনি ব্যর্থতায় তাদেরকে হতাশ বা বকাবকি না করে উৎসাহিত করা। বাবা-মা, সন্তানসহ পরিবারের সবাই এক সাথে ঘুরতে যাওয়া। সবাই মিলে একসাথে খেতে বসা। অবসর সময় সবাই মিলে গল্প করা। সবাই সবার সাথে ব্যক্তিগত কথাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। কোনো সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্যে সঠিক পরামর্শ দেয়া। সন্তানের ভালো কাজে উৎসাহিত করা। একসাথে খেলাধুলা করা। সমাজিক অন্যায়গুলো নিয়ে মাঝে মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করা। যেটা খারাপ সেটা খারাপ হিসেবে তুলে ধরা, ভালোটাকে দেখিয়ে দেয়া। সর্বোপরি অভিভাবকরাই পারেন বিপথগামী সন্তানদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে।
মানুষ সামাজিক জীব। সে প্রতিনিয়ত অন্যের সঙ্গ ও সান্নিধ্য কামনা করে আসছে। সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ সংঘবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করে আসছে। তাই ব্যক্তি জীবনের সার্থকতা নির্ভর করে সমাজ ও পরিবেশের ওপর। সেই সমাজ ও পরিবেশ মানুষের ব্যক্তিত্ব দ্বারাই প্রভাবিত হয়। জীবনের যথার্থ ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে সৎ সাহচার্যের বিশেষ প্রয়োজন। সৎ সহচার্য মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণতার দিকে উন্নীত করে। এর বিপরীত দিকটাই হল বিপথগামিতা। বিপথগামিতা মানুষের ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, সুনাম এমনকি সাফল্যকেও ধ্বংস করে।আমাদের সমাজে অনেক বাবা-মার সন্তান বিপথগামী হচ্ছে। এর কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, বাবা-মার উদাসীনতার কারণে সন্তান বিপথগামী হচ্ছে। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, এসব খোঁজ-খবর অনেক বাবা-মাই রাখেন না। পারিবারিক অসচতেনতা এ ক্ষেত্রে দায়ী। অভিভাবক যদি সচেতন হন তাহলে তার সন্তান কখনো বিপথগামী হতে পারে না। এজন্য শুধু অভিভাবকই দায়ী নন। সঙ্গ দোষেও অনেক সন্তান বিপথগামী হচ্ছে।
শেখ সাদী বলেছেন, “সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ।” এজন্য অভিভাবককে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে তার সন্তান কার সাথে চলাফেরা করছে। যে মানুষটার সাথে চলাফেরা করছে, সে ভালো কি-না। যতটুকু সম্ভব ওই মানুষটার সাথে সন্তানকে মিশতে না দেয়াই উত্তম। সন্তানের বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অভিভাবক ভূমিকা রাখতে পারেন। এসব বিপথগামী সন্তানের জন্যে শুধু অভিভাবকই দায়ী নন। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো আজ কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, ফলে শিক্ষা জগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুব সমাজকে বিপথগামী করছে।
আজ আমরা প্রত্যক্ষ বিস্ময়ে অবাক হই, সমাজে সমাজ বিরোধীদের যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা যেখানে লাঞ্ছিত, অসহায় বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ। প্রশাসন প্রয়োজন মত ওদের ব্যবহার করে। কী তাদের মূলধন? তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই মূলধন নিয়েই ওরা সমাজের বিশিষ্ট মানুষ। আজ তাদের সান্নিধ্য এসে আমাদের যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে, বিপথগামীতার দিকে অগ্রসরমান। এসব বিপথগামীতার কারণে যুব সমাজ তথা আমাদের সন্তানেরা নেশাখোর হচ্ছে, চুরি করছে, ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি খুন পর্যন্ত করছে।এসব বিপথগামী সন্তানদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব প্রত্যেক অভিভাবকের।
বাবা-মার উদাসীন মনোভাব সন্তানকে বিপথগামী করে তুলছে। সন্তানকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে অভিভাবককে যা করা প্রয়োজনঃ সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে তার প্রতি খেয়াল রাখা, চলার ক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া। সন্তানের সাফল্যে যেমন প্রশংসা করবে, তেমনি ব্যর্থতায় তাদেরকে হতাশ বা বকাবকি না করে উৎসাহিত করা। বাবা-মা, সন্তানসহ পরিবারের সবাই এক সাথে ঘুরতে যাওয়া। সবাই মিলে একসাথে খেতে বসা। অবসর সময় সবাই মিলে গল্প করা। সবাই সবার সাথে ব্যক্তিগত কথাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। কোনো সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্যে সঠিক পরামর্শ দেয়া। সন্তানের ভালো কাজে উৎসাহিত করা। একসাথে খেলাধুলা করা। সমাজিক অন্যায়গুলো নিয়ে মাঝে মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করা। যেটা খারাপ সেটা খারাপ হিসেবে তুলে ধরা, ভালোটাকে দেখিয়ে দেয়া। সর্বোপরি অভিভাবকরাই পারেন বিপথগামী সন্তানদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে। আর এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকাই বেশি। কেননা নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দিব।” সন্তান কোথায় যায় কী করে সেটা যদি মা খেয়াল না করে তাহলে সন্তানতো বিপথগামী হবেই কোন বন্ধুটির সাথে চলছে তার সন্তান সেদিকে কিন্তু মাকেই নজর দিতে হবে।
শুধু পড়াশোনার জন্যে চাপ সৃষ্টি করলে হবে না। তার প্রতিভা বিকাশের জন্যে সে যা করতে আগ্রহী তার সহযোগিতা করতে হবে। সন্তান যখন খারাপ হয় তখন তাকে শাসন নয়, আদর ভালোবাসা দিয়ে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। কেননা শাসনের চেয়ে ভালোবাসার শক্তি বেশি। শুধু অভিভাবক নয়, সন্তানকেও বাবা-মার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, কেননা ‘রাম পিতৃশর্ত পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাস করেছিলেন, ভীমসেন মাতার আজ্ঞায় রাক্ষস মুখে যেতেও দ্বিধাবোধ করেননি।’ সুতরাং পিতামাতার কথা মত চলা প্রত্যেক সন্তানেরই কর্তব্য। শাস্ত্রে আছে, বিদ্বান এবং ভক্তিমান নয় এমন সন্তানের জন্মের প্রয়োজন নেই। সুতরাং সন্তান ভালো করার দায়িত্ব অভিভাবক বা পিতামাতার। অভিভাবকই পারেন সন্তানকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে। কোনো পিতামাতাই তার সন্তানের বিপথগামিতা কামনা করে না। পিতামাতার সঠিক দিক নির্দেশনাই বিপথগামিতার অন্তরায় হিসেবে নেয়ামক ভূমিকা পালন করে।
প্রত্যেক মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। জন্মিলে মরিতে হয়। বাঁচিলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। বিবাহ বন্ধনে মানব জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কনজুগাল লাইফ থেকে সন্তানের কামনা সূচনা হয়। প্রত্যেক দম্পতি চায় তার ঔরসজাত সন্তান। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমার গুণে কেউ পায় কেউ পায় না। তাই তো না পাওয়ার বেদনা এবং পেয়েও হারানোর বেদনা মানব জীবনকে দুর্বিষহ করে আস্তে আস্তে যন্ত্রণার আস্তাকুড়ে নিয়ে চলে। ভালো-মন্দ নিয়েই জীবন। গতিশীল পৃথিবী রহস্যময়। বিশ্বের সকল প্রান্তে নানা পরিবার বাস করে, জন্ম দেয় নানা ঘটনা অঘটনা। পজেটিভ ঘটনা জন্ম দেয় পথগামিতা আর নেগেটিভ ঘটনা বয়ে আনে দুর্বিষহ যাতনা এবং বিপথগামিতা। কথায় বলে, যাহা চাই তাহা পাই না, যাহা পাই তাহা চাই না।সবার প্রত্যশা থাকে পরিবারের সন্তান কাজে বড় হবে, সে কথায় বড় হবে না। সে সন্তানকে কেউ চায় না যে সমাজ জীবনে হবে কুলাঙ্গার। কিন্তু বিধিবাম, বিপথগামী সন্তান নিয়ে অভিভাক নানা পেরেশোনে ভোগে। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারিশমার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলে হয়তোবা ভবিষ্যতে যারা পথগামী সন্তানের প্রত্যাশায় প্রহর গুণছেন তারা তথা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজ জীবন হবে বিপথগামিতার রক্ষাকবজ।
সন্তান আল্লাহর দান। সমাজ মানব সৃষ্ট। পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা কর এই সত্য উপলব্ধি থেকে বিপথগামী সন্তানের দোষ না দিয়ে পর্দার অন্তরালের খোঁজ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কোন সন্তান বিপথগামী রূপ নিয়ে জন্মায় না। এই সমাজ, সংসার, অভিভাবক এর দায়ভার এড়ানোর চেষ্টা করলে মহান সৃষ্টিকর্তার ফাঁসির মঞ্চে তাকে দাঁড়াতে হবে।জন্ম দেয়া সহজ কিন্ত কর্ম দেয়া কঠিন। সন্তান পৃথিবীতে আসার পূর্ব এবং পর করণীয়ের অযোগ্যতাই বিপথগামিতার মূল কারণ। কোন কাজই পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ভালো হয় না। আর সঠিক পরিচর্যার অভাবে অনেক সন্তান বিপথগামী হয়ে যায়।
প্রথমেই পূর্ব প্রস্তুতির কথা ধরা যাক।আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু অর্থের অভাবে আমি বিয়ে করতে পারছি না। তখন নবীজী তাকে বললেন, তুমি রোজা রাখ। এতে যে তোমার অর্থের সঞ্চয় হবে তা থেকে বিবাহের দেনমোহর ও অন্যান্য খরচাদি সঙ্কুলান হবে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে আল্লাহর হাতে এটা ধ্রুব সত্য। বিবাহের পূর্বে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।রূপে চোখ জুড়ায় আর গুণে হৃদয় জুড়ায়। জীবন সঙ্গীর কাছে প্রত্যাশা গুণ থাকাই উচিত। খোদাভীরু জীবন সঙ্গী, শিক্ষার ভীত উচ্চমানসম্পন্ন একান্ত প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন অতিবাহিত করা। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজন।সন্তান পৃথিবীতে আসে নিষ্পাপ দেহ নিয়ে। এই নিষ্পাপ দেহ-মনকে লালন-পালন ও পরিচর্যার সঠিক পারফরমেন্সের অভাব দেখা দিলেই সন্তান ধীরে ধীরে বিপথগামী হতে শুরু করে। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখামাত্র অভিভাবক হিসেবে পিতামাতাকে প্রথম মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে হবে। সন্তানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সঞ্চয়ী মনোভাব পোষণ করতে হবে। সন্তানকে চাহিদার অতিরিক্ত কোন কিছুই সরবরাহ না করা, শিশুকে আত্মনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরনির্ভরশীলতা হতে দূরে রাখতে হবে। সন্তানের সঙ্গী-সাথীর সাহচার্য নির্বাচন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক। সন্তানের সামনে পিতামাতাকে কখনো তর্ক-বিতর্ক করা উচিত হবে না। পিতামাতা উভয়কে সন্তানের মঙ্গল কামনায় সময় ও সাহচার্য দিতে হবে। সন্তানের সুখ চিন্তা করে অভিভাবকে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে থাকতে হবে। সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। সন্তানের জন্যে কখনো তার পড়ার সাথী, খেলার সাথী এবং কখনো তার চলার সঙ্গী হতে হবে।
সন্তানের বিপথগামিতার পেছনে অভিভাবকগণ যে বড় ধরনের ভুল করে থাকেন তার পেছনে অন্যতম বড় ভুল হলো তাকে অত্যাধিক কঠোর পরিবেশে রাখা এবং মাত্রাতিরিক্ত শাসন করা। সন্তানের প্রতি উদাসীন থাকা তাদের স্নেহ-ভালোবাসার মত সময় না থাকা। সন্তানের প্রতি সময় বরাদ্দ না রাখা। সামাজিকতা বর্জিত কাজে লিপ্ত থাকা ধর্মীয় অনুশাসন না মানা। হালাল আয় রোজগার না করা। সত্য ও ন্যায়ের পথে না থাকা।জগত সংসার মায়াময় এই মায়াময় জীবনে সন্তানের সঠিক দিক নির্দেশনা হলো অভিভাবক। অভিভাবকগণ শক্ত হাতে হাল ধরলে সুপথে থাকতে বাধ্য।