আনন্দ আয়োজনে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হল ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা
এ্যন্থনী পিউস গোমেজ, ভার্জিনিয়া
গত ২৩শে এপ্রিল, ২০১৬ ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনের গেইটওয়ে পার্কের উন্মুক্ত সবুজ প্রাঙ্গনে ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার সর্ব বৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নববর্ষ বরণ ও বৈশাখী মেলা-১৪২৩। গেইটওয়ে পার্কের গোটা চত্বর ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার প্রবাসী বাঙ্গালীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল নব বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে, সবার প্রানের উচ্ছাসে, নতুন স্বপ্নের সোনালী প্রত্যাশায় নতুনকে গ্রহন করার আনন্দে।
“নব আনন্দে জাগো আজি নববিকিরণে, শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে,
উৎসারিত নব জীবন নির্ঝর উচ্ছসিত আশাগীতি, অমৃত পুস্পগন্ধ বহে আজি এই শান্তি পবনে।”
সত্যি সবাই বর্ষবরণের এই দিনে অনুভব করছিল নতুনের আবাহন, নতুনের ডাক, খোলা আকাশের নীচে সবুজ চত্বরে বয়ে যাওয়া শান্তির হাওয়ায় যেন কবিগুরুর গানের এই কথাগুলোই গুঞ্জরিত হচ্ছিল সবার মনের গহীনে, এক আপ্লুত শিহরণে।
বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের উজ্জ্বল আমেজ এবং অনুভব এখনো ম্লান হয়ে যায়নি সময়ের ব্যবধানে বা আধুনিকতার ছোঁয়ায়। মানুষের মননশীলতায় পরিবর্তন এসেছে সন্দেহ নেই এবং আবর্তন-বিবর্তন, পরিবর্তন সবই জীবনের স্বাভাবিক অগ্রসরমান গতিময়তার অংশ। তাই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অনেক কিছু আমরা পেছনে ফেলে আসি, কিন্তু ফেলে আসা যায়না স্বদেরশের স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি আমাদের অন্তরের ভালবাসা, স্বদেশী সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের গভীর অনুরাগ এবং অন্তরের টান। কারন স্বদেশ এবং স্বদেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের মধ্যের আমাদের অস্তিত্বে্র শেকড়। তাই প্রতি বছর যখন পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নব বর্ষ আমাদের দ্বারপ্রান্তে এসে উঁকি দেয়, তখন তাকে বরণ করার জন্য আনন্দ-উচ্ছাসে আমরা উদ্বেলিত হয়ে উঠি, চারিদিকে বাজতে থাকে নব বর্ষবরণের প্রস্তুতির ঢোল। আয়োজনের মেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেরীল্যান্ড-ওয়াশিংটন-ভার্জিনিয়া এলাকার বেশীর ভাগ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। আর তার পথ ধরেই এবারও নব বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছিল অত্র এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন “ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি”।
ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র এই আয়োজন ছিল ব্যপক মাত্রার। মেলা প্রাঙ্গণে ভীড় জমেছিল ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার সহস্র প্রবাসী বাঙ্গালীর উপস্থিতিতে, পসরা সাজিয়ে বসেছিল রকমারী গহনা ও কাপড়ের দোকান, বাহারী স্বদেশী খাবারের ও মনোহারী দ্রব্যের দোকান, সামাজিক-ব্যবসায়িক সেবাদানকারী অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের ব্যনার-শোভিত স্টল। পুরো চত্বর যখন কানায় কানায় পূর্ণ- তখন একদিকে চলছিল বিশাল মঞ্চজুড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেশ, অন্যদিকে বাঙ্গালীর চিরপরিচিত আড্ডা। হাসির কলরোলে বিকেলের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে চারিদিক মেতে উঠেছিল এক মিলন মেলায়।
সকালে মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির অক্লান্ত বর্ষনে অনেকের মনটা ভারী হয়ে উঠেছিল আয়োজিত বর্ষবরণে যাওয়ার প্রত্যাশিত আশার অপ্রত্যাশিত বিঘ্ন দেখে। কিন্তু দুপুরের পর পর সে মেঘলা আকাশের মেঘের বুক চিরে যখন উঁকি দেয় সূর্যালোক, তখন সবার মনটা যেতে পারার আনন্দে আবার নেচে ওঠে। তাইতো সবাই বৈশাখী সাজে নিজেকে সাজিয়ে হাজির হয়ে যায় “ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি”র আয়োজিত বৈশাখী মেলায়। সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে তোলার জন্য আয়োজনজুড়ে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- যেখানে সঙ্গীত এবং নৃ্ত্য পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দান করেন সব জনপ্রিয় স্থানীয় শিল্পীরা এবং শেষ পর্বে বাংলাদেশ থেকে আগত জনপ্রিয় ব্যন্ড “লালন”। অনুষ্ঠানটির প্রাঞ্জলভাবে সঞ্চালনা করেন লেখক, সাংবাদিক জনাব শিব্বির আহমেদ।
আয়োজিত এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যারা সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তারা হলেনঃ ব্যান্ডদল “বিবাগী”, ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র পক্ষ থেকে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আবু রুমী, শামসুন রুমী, ফাহমিদা হোসেন শম্পা, রচনা মওলা, সাব্রিনা রহমান, এ্যমেলিয়া শারমিন, বুলবুল আক্তার, শিমুল সরকার, রুক্সানা পারভিন ও শম্পা বণিক। এছাড়াও একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন কৌশিক বড়ুয়া, রবিউল আলম, সামিয়া জুবায়ের, শেখ মওলা মিলন, কালাচাঁদ সরকার, প্রীতি, টগর, উৎপল বড়ুয়া, ও আফসানা সিরাজ। যাদের নৃত্যের ঝংকারে কেঁপে উঠেছিল এই প্রথমবারের মত কোন সবুজ মাঠের খোলা চত্ব্রর, তারা হচ্ছে- “সৃষ্টি নৃ্ত্যাঙ্গন”- কোরিওগ্রাফার- রোজমেরী মিতু গনসালভেজ, “মঞ্জরী নৃ্ত্যালয়”- কোরিওগ্রাফার গ্লোরিয়া শিল্পী রোজারিও, সিন্থিয়া গোমেজ ও তার দল, কোরিওগ্রাফার- সিন্থিয়া গোমেজ। আবৃত্তিতে ছিলেন সাংবাদিক, লেখক জনাব হারুন চৌধুরী। আর অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত অন্যতম জনপ্রিয় ব্যন্ডদল “লালন”। দলের প্রধান ভোকালে ছিলেন নিগার সুলতানা সুমী। ব্যন্ডদল “লালন” গত ২০০৭ সালে তাদের যাত্রা শুরু করলেও ইতিমধ্যে তারা বেশকিছু গানের এলবাম বের করে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গীত পরিবেশন করে বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র আয়োজিত এই বৈশাখী মেলায়ও তারা তাদের মন মাতানো জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। সবাই প্রানভরে তাদের গান উপভোগ করেন। আয়জিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যারা যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন, তারা হলেনঃ সাঊন্ড ও গীটারে শিশির, অক্টোপ্যাডে প্রান্তিক, কি-বোর্ডে সৌ্মী, অনিক, ড্রামে কেনী, তুর্য, তবলায় আশীষ বড়ুয়া, বাপ্পী। এছাড়া মেলায় স্টল ব্যবস্থাপনায় ছিলেন নুরুল আমিন এবং মঞ্চ সজ্জায় উৎপল সাহা।
অনুষ্ঠানের আরেকটি পর্ব ছিল সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অবদান রেখে যাচ্ছেন, সেইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র পক্ষ থেকে এওয়ার্ড দিয়ে অভিনন্দন জানান। যারা এবারের এওয়ার্ড পেলেন, তারা হলেনঃ অর্থনীতিবিদ ডঃ ফায়জুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ড: বদরুল হুদা খান, নিউজবিডি ইউএস এর সম্পাদক এস এম জাহিদ রহমান, সাংবাদিক সুবীর কাশ্মীর পেরেরা, রিয়েলটর আবু হক, ব্যান্ড শিল্পী শামষীশ সুহাষ, নাঈম রহমান ও ইনাম হক।
অনুষ্ঠানের গ্র্যান্ড স্পন্সর ছিলেন ডাটা গ্রুপের জনাব জাকির হোসেন, গোল্ড স্পন্সর ছিলেন মিসেস রুক্সানা পারভীন। অনুষ্ঠানের র্যাফল ড্র-এর পুরস্কার হিসেবে ৪০” রঙ্গীন টিভি, প্রিন্টার ও ট্যাবলেট উপহার দেন অনুষ্ঠানের আরেক স্পন্সর জনাব আবু হক। গ্র্যান্ড স্পন্সর জনাব জাকির হোসেন তার বক্তব্যে এই বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা আয়োজন করার জন্য এবং ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকায় বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য “ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি”কে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে প্রবাসী বাঙ্গালীদের পেশাগত মান উন্নয়ন করে জীবনমান পরিবর্তন করে উন্নততর জীবনযাপনের জন্য সবাইকে অনুপ্রানিত করেন। তিনি বলেন যে, সবার মেধা কাজে লাগিয়ে, প্রয়োজনীয় যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে এই পেশাগত পরিবর্তন সম্ভব এবং ডাটাগ্রুপ ইউএসএ-র মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ তা করে যাচ্ছে। তিনি চাকরীপ্রত্যাশীদের ডাটাগ্রুপে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আমন্ত্রন জানান যাতে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে আই,টি পেশার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবনমান পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়ে উঠে।
অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফী ও মিডিয়ার দায়িত্বে ছিলেন এ্যন্থনী পিউস গোমেজ, এস এম জাহিদ রহমান, সুবীর কাশ্মীর পেরেরা, আব্দুস সাত্তার, শরাফত হোসেন বাবু, হারুন চৌধুরী, রাজীব বড়ুয়া, রফিকুল ইসলাম আকাশ এবং বিপ্লব দত্ত।
অনুষ্ঠান শেষে ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি’র কর্ণধার জনাব আবু রুমী এবং আকতার হোসেন সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তাদের আয়োজিত এই বর্ষবরণে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের জন্য।
সারাদিনের আনন্দমুখর একটি চমৎকার বৈশাখী মেলার আনন্দস্মৃতি বুকে নিয়ে সবাই যার যার ঘরে ফিরে যায়, মনের গহীনে তৃপ্তির অনুভব এই ভেবে যে- “আমরা আজ আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে এলাম”।