আবারও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জাতীয় পার্টি
আবারও সরকারে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে জাতীয় পার্টি। তারা একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করার মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদীয় দলের প্রথম সভা শেষে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, জাপা মহাজোটে ছিল, আছে, থাকবে। এসময় তিনি দাবি করেন, জনগণ চায় না বিরোধী দল সংসদে থাকুক।
জাতীয় পার্টি মহাসচিবের যুক্তি- ‘৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন মহাজোট পেয়েছে। ২৮৮টিতেই মানুষ ভোট দিয়েছে মহাজোটের পক্ষে। সুতরাং আপনাদের ধরে নিতে হবে মানুষ বড় ধরনের কোনো বিরোধী দল চায় না।’
মানুষ সরকারের ওপর সন্তুষ্ট বলেই মহাজোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন জাপা মহাসচিব আরও বলেন, সরকার বা বিরোধী দল কোথাও থাকতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্ত এলাকার উন্নয়নের জন্য সবাই মহাজোটে থাকতে আগ্রহী।
অথচ জাতীয় পার্টির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই মনে করেন এমন সিদ্ধান্তে দল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সংসদে দ্বৈত ভূমিকার কারণে গতবারের চেয়ে জাতীয় পার্টির এবারের আসন কমেছে। জাতীয় পার্টির এ ধরনের ভূমিকা নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একই সঙ্গে বিরোধী দলে ও সরকারের অংশীদার হয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করা যায় না। বিরোধী দল সরকারের অংশ হতে পারে না। গত মেয়াদে সরকারের অংশ হয়েছিল বলেই এবার সংসদে দলটির আসন কমেছে ১২টি।
ফের যদি তারা সরকারের অংশ হয় তবে আগামীতে আরও আসন কমবে। এক পর্যায়ে জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে তারা মনে করেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, দ্বৈত ভূমিকার কারণে অনেক সময় ইচ্ছা না থাকলেও সরকারের নেতিবাচক কাজের দায় নিতে হয়ে জাতীয় পার্টিকে। একই ভাবে বিরোধী দলের ভূমিকার কারণে সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। এসব কারণে দল যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি ক্ষুণ্ণ হয় সরকারের ভাবমূর্তিও।
এসব কারণে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতাকর্মীও চান না জাতীয় পার্টি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদ নিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের অংশীদারিত্ব করুক। তারা নিজেদের দলকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকায় দেখতে চান।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দ্বৈত অবস্থান তারা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না বলে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। নেতাকর্মীরা মনে করেন দলের দু-চারজন নেতা মন্ত্রী হওয়ার জন্য ব্যক্তি স্বার্থে দলের বড় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছেন।
এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, প্রকৃত অর্থে বিরোধী দল হতে না পারলে জাতীয় পার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। ত্যাগী নেতাকর্মীরা তাদের প্রিয় দলের এ করুণ পরিণতি দেখতে চান না। বরং জনমুখী বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে দলকে শক্ত হাতে এগিয়ে নেয়ার দাবি জানান।
দশম জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়েও সরকারের অংশীদার হয়েছিল। একজন মন্ত্রী এবং দুই প্রতিমন্ত্রী হন দলের তিন নেতা। এরা মন্ত্রিসভায় থাকায় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি জাতীয় পার্টি।
এতে ৫ বছর ধরে তীব্র সমালোচনার মুখে ছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। দলের ক্ষতি করে লাভবান হয়েছেন মাত্র গুটিকয়েক নেতা। তারা সরকারের নেতিবাচক কোনো কাজের সমালোচনা না করে দলকে চাপের মধ্যে ফেলেছেন।
নেতাকর্মীদের দাবি থাকলেও সংসদে সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তারা তেমন কিছুই বলেননি। গত মেয়াদে অনেকবার বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে সরকার পক্ষ ছাড়ছেন। সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়গুলো আলোচনাও হয়েছে।
দলের চেয়ারম্যানও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেননি। এতে দল দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা মনে করেন মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে সরকার থেকে বেরিয়ে এলে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো।
কিন্তু এসব না করায় দলের জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের আসন কমেছে। দশম জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন পেয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনে পায় ২২টি। গতবারের চেয়ে এবার ১২টি আসন কমেছে।
অবশ্য এবারের নির্বাচনকে গতবারের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলেন, ধানের শীষ যেখানে মাত্র সাতটি আসন পেয়েছে, সেখানে ২২ আসন পেয়েছে লাঙ্গল। ২২ আসন পেয়েই জাতীয় সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয় এতে করে জাতীয় পার্টিই দল হিসেবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা সরকারের শরিক না হয়ে কেবলমাত্র বিরোধী দলে থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করলে দল হিসেবে লাভবান হতো, সংসদও অর্থবহ এবং কার্যকর হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবার জাতীয় পার্টি কী করবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এবারও যদি তারা সরকারের সঙ্গে থাকে তাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’
সংসদ বিষয়ক গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদে যে বিরোধী দল ছিল তাকে বাস্তবে বিরোধী দল বলা যায় না। কারণ তারা তো সরকারেই ছিল। এবারও একই অবস্থা হলে তা ভালো হবে না।’
দলের ভালো চাইলে সরকারের অংশীদার হওয়া যাবে না। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকলে মহাজোটের শরিক হিসেবে সরকারেরও লাভ হবে দল হিসেবে জাতীয় পার্টিও উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দলের কেউ মন্ত্রী হলে সরকারের সব ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। তখন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে হলেও নেতিবাচক কোনো কাজের সমালোচনা করা যায় না। সংসদেও কিছু বলা যায় না, বাইরেও নয়। নেতিবাচক কিছু বললেও মানুষ বিশ্বাস করে না।
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সরকারের ভালোমন্দ সব কাজের দায় নিতে হয়। অন্য দিকে এ ধরনের শরিকরা সরকারের জন্যও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে সরকারে থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল যে কোনো ইস্যুতে আন্দোলনে নামলে একই সঙ্গে সরকার এবং সংসদে বিরোধী দলে থাকা সংগঠনের নেতারা ক্ষমতাসীনদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে, যা অনেক সময় সরকারকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।
তারা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে দু’পক্ষের জন্যই একটা পিছুটান কাজ করে, যা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। এ অবস্থা থেকে দুপক্ষেরই বেরিয়ে আসা উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির সদস্য সংখ্যা কত- এ বিষয়টি প্রাধান্য না দিয়ে তারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলে সব পক্ষের জন্যই তা ভালো হবে। কম আসন বিরোধী দল হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে না। অল্প আসন পেয়েও কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা যে পালন করা যায় তার উদাহরণ আছে অনেক।’
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে সংসদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জাপার প্রায় সব সাংসদই সরকারে থাকার পক্ষে অভিমত দেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।
বৈঠকে উপস্থিত জাপা সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা জানান, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ আমরা সবাই এখন মহাজোটের এমপি। জনগণও আমাদের মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সবাইকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। তাই সবাই মহাজোটে থাকবো, সবাই মিলে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করবো।
তিনি জানান, বিরোধী দলে নয়, মহাজোটে থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। তবে সবকিছুই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার।
জানা গেছে, একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে- তা নির্ধারণে জাপার নব নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ্ এরশাদ ছাড়া বাকি সব সাংসদ উপস্থিত ছিলেন।