আলোকচিত্রী শহিদুল আলম : ‘অনেকে এখন চুপ, তাই আমার কণ্ঠস্বর স্পটলাইটে’

598

“দ্যা গার্ডিয়ান্স এন্ড দ্য ওয়ার অন ট্রুথ।” যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম সাময়িকী ২০১৮ সালে যাদের বছরের আলোচিত চরিত্র বলে বাছাই করেছে তাদের এভাবেই বর্ণনা করেছে। এরা সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়া সাংবাদিক।

_104753710_gettyimages-1063826754

সেই তালিকায় আছেন নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজি। আছেন মিয়ানমারে আটক রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন এবং কিয়া সো। আছেন ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা। আরও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত ক্যাপিটাল গেজেট পত্রিকার পাঁচ জন।

টাইম ম্যাগাজিন তাদের এই বিশেষ সংখ্যায় আরও যেসব নির্যাতিত সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের শহিদুল আলম। আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া যে আলোকচিত্রীকে বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকমাস বন্দী করে রেখেছিল।

টাইম ম্যাগাজিনের এই সম্মাননাকে তিনি কীভাবে দেখছেন?

বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল আলম বলেন, “আমার মতো আরও একশো জন যদি আমার মতো কথা জোর গলায় বলতো, তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে সেরকম আলাদাভাবে দেখা হতো না। আমাকে চিহ্ণিত করা হতো না বা আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যে আচরণ করা হলো, সেটাও হয়তো ঘটতো না।”

শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তরুণ শিক্ষার্থীদের এক ব্যাপক আন্দোলনের সময়। তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ এনেছিল বাংলাদেশ সরকার।

কিন্তু শহিদুল আলম মনে করেন তাঁকে ধরা হয়েছিল ভিন্নমতের কন্ঠরোধের জন্য।

“আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলো নতুন নয়। ঘরে ঘরে সবাই বলে। প্রকাশ্যে বলে না। আর আমি যা করছি, তা তো অনেককাল ধরেই করছি। কিন্তু এখন যেহেতু বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সেখানে আমার ভূমিকাটা হয়তো আরও পরিস্কার হয়ে গেছে। যেহেতু অনেক মানুষ চুপ করে আছে, তখন একটা কন্ঠস্বর অনেক বেশি লাইমলাইটে বা স্পটলাইটে আসে।”

ছবির কপিরাইট Getty Images
Image caption শহিদুল আলমের মুক্তি চেয়ে ঢাকায় বিক্ষোভ

টাইম ম্যাগাজিন যে এবার পার্সন অব দ্য ইয়ার হিসেবে সাংবাদিকদের বেছে নিয়েছে, তা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে বলে মনে করেন শহিদুল আলম।

” এই মুহূর্তে অন্যদের ওপর লোকে যখন আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, হাতড়ে বেড়াচ্ছে কার ওপর আমি আস্থা রাখতে পারি, সাংবাদিক মহলের মধ্যেও যখন পচন ধরেছে- তার মধ্যেও কেউ কেউ এর উর্ধ্বে উঠে জোর গলায় সত্য কথা বলার চেষ্টা করছে। এরকম সাহস যারা দেখায়, তাদেরকে আমাদের অবশ্যই সম্মান করতে হবে।”

তার মতে, বিশ্ব জুড়েই সাংবাদিকতার জন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

” যেখানে যেখানে যত বেশি নিপীড়ন সেখানে তত বেশি ভয় তৈরি হচ্ছে। নিপীড়ন যেখানে নেই সেখানে সাংবাদিকতায় সেরকম সমস্যা হয় না।”

বাংলাদেশে নতুন প্রযুক্তির বিকাশের পাশাপাশি যখন কীনা গণমাধ্যমের অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করার কথা, সেখানে যে এর উল্টো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

“আজকে বাংলাদেশে অনেক পত্রিকা, অনেক টেলিভিশন, অনেক রেডিও। তা সত্ত্বেও গণমাধ্যম যে ভূমিকা রাখতে পারে না, সেটাই আমার কাছে খুব চিন্তার বিষয়। কিছু কিছু গণমাধ্যম তো নিজেদের একেবারে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। অনেকে বিভিন্ন ভাবে সরকার থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে সরকারের বুলিকেই সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। এটা একটা ভয়ের বিষয়।”

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায়ও হতাশ তিনি।

” যেখানে বুদ্ধিজীবীদের এত জোরালো ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে এতটাই তারা গুটিয়ে গিয়েছে, তাদেরও তো জনগণের আস্থা রাখার সুযোগ এত কম। বুদ্ধিজীবীদের তো কেনা যায়, তাদের পোষা যায়। যারা পোষা বুদ্ধিজীবী নয়, তাদেরই ভয় পায়। “

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.