ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’
ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এভাবেই ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র।
সব মিলিয়ে নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা চলতি মাসকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ বলে অভিহিত করছেন।
একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এ কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার–সংকটের পর টাকার সংকট বড় আলোচনার বিষয়। ব্যাংক তিনটির নথিপত্র পর্যালোচনা করে এ সব তথ্য মিলেছে।
এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন চলছে। মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ঋণ নেওয়া এসব কোম্পানি। ফলে দ্রুত সময়ে এসব অর্থায়নের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।
নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ পরিশোধে বিরতি) দেওয়া হয়েছে এক বছর। ফলে এক বছরের মধ্যে কোনো অর্থ শোধ দিতে হবে না। এসব ঋণের ভবিষ্যৎ বুঝতে কমপক্ষে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। সূত্রগুলো জানায়, এসব ঋণের সুবিধাভোগী ব্যাংক তিনটির মালিকপক্ষই। যেসব কোম্পানির নামে টাকা তোলা হয়, তার মধ্যে একটির মালিকের ঠিকানা চট্টগ্রামে। আর বাকিগুলো রাজশাহীতে। বেশির ভাগ কোম্পানির নথিপত্রে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্স মণ্ডল। গ্রুপের এমডি মো. আমিনুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহান নাবিল ফিড মিলের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন মোখলেছুর রহমান, আনোয়ার ইসলাম। আবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মিফতাহ উদ্দিনও রয়েছেন একটির মালিকানায়।
নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটের হিসাবে, গ্রুপটির কোম্পানির সংখ্যা ১৭। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাবিল নাবা ফুডস, ফ্লাওয়ার মিল, ফিড মিল, অটো রাইস মিল, ডাল মিল, কনজ্যুমার প্রোডাক্টস, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম ও নাবিল ট্রান্সপোর্ট।
সরেজমিন ঢাকা
নাবিল গ্রেইন ক্রপসকে ১ হাজার ১১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান সার্কেল-২ শাখা। এর মধ্যে গত ৬, ৭ ও ১৯ জুলাই দেওয়া হয় যথাক্রমে ২৯৩ কোটি, ৪৩১ কোটি ও ৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের নথিপত্রে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া বনানীর ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি আবাসিক ভবন। ভবনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. হারুন বলেন, ‘আবাসিক হওয়ায় এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ নেই।’
এই প্রতিবেদক ব্যাংকে গেলে গুলশান সার্কেল-২ শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে চলতি বছরের মার্চে শাখায় প্রতিষ্ঠানটির হিসাব খোলা হয়। এরপর যা নির্দেশ এসেছে, সেই মোতাবেক অর্থায়ন করা হয়েছে।
মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ১–১০ নভেম্বর সময়ে ৯৮১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখা। এর মধ্যে এক দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিন ১০৫ থেকে ১৬৫ কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের নথিপত্রে দেওয়া বনানীর ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে।
অফিসে উপস্থিত আল আমিন ও বুলবুল নামের দুই কর্মী জানান, মার্টস বিজনেস লিমিটেড নামে নাবিল গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সরেজমিনে আরও জানা গেল, সম্প্রতি পাশের ১১ নম্বর ভবনটি পুরোটাই কিনে নিয়েছে নাবিল গ্রুপ।
ঠিকানায় কোম্পানি নেই, এরপরও কেন ঋণ দিলেন—এ প্রশ্নের জবাব দেননি ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখার ব্যবস্থাপক আবদুর রব মৃধা। তিনি জানান, এসব বিষয়ে প্রধান কার্যালয় কথা বলবে। তাঁদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তিনি ২০২১ সালের জুলাই থেকে শাখার দায়িত্বে।