এক দশক পর জন্মভিটেয় কবি আল মাহমুদ

701

কবি মাত্রই আবেগপ্রবণ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদও তা থেকে ব্যতিক্রম নন। বহু আগেই রাজধানীতে স্থায়ী বাস গড়েছেন। বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হয় না।

Al_Mahmud_B. Baria_home

কিন্তু, জন্মভিটার প্রতি টানটা ঠিকই ছিল। এরই মধ্যে কবির কানে এলো, প্রয়োজনেই স্বজনেরা তার প্রিয় চৌচালা ঘরটি ভেঙে, সেখানে সুরম্য দালান করেছেন।

‘সোনালী কাবিন’র স্রষ্টা তাতে ব্যথা পেলেন। মনঃকষ্ট থেকেই আগের টুকটাক যাওয়াটাও এবার বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে কেটে গেছে প্রায় এক দশক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া গেলেও বাড়িতে যাননি কবি।

অবশেষে কবি তার জ্ন্মভিটেয় ফিরলেন। শনিবার রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে। তবে, আগের আল মাহমুদ নন, তার কফিন।

আল মাহমুদের মরদেহবাহী ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স শহরের দক্ষিণ মৌড়াইল মোল্লা বাড়িতে পৌঁছলে সবার মাঝে কান্নার রোল পড়ে যায়। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মরদেহের সঙ্গে ৫টি মাইক্রোবাসে কবির সন্তান, নিকটাত্মীয় ছাড়াও সহযোগীরা মোল্লা বাড়িতে আসেন। সবার চোখে-মুখেই বিষাদের ছায়া।

কবি আল মাহমুদের মামা হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি জানান, রোববার সকালে আল মাহমুদের মরদেহ নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে রাখা হবে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবেন। দুপুরে একই স্থানে নামাজে জানাযা হবে। এরপর দক্ষিণ মৌড়াইল কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

 কবির ঘনিষ্ঠ সহচর আবিদ আজম বলেন, ‘কবি আল মাহমুদ ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে তাকে চাকরি দিয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আল মাহমুদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়া উচিত। সন্তানেরাও বাবার শেষযাত্রাটা রাষ্ট্রীয় সম্মানে চান।’

এর আগে গতকাল শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কবি আল মাহমুদ (৮২)। তার মৃত্যুর খবরে শোক নেমে আসে তার জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

শনিবার সকাল থেকেই কবির বাড়িতে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে। সময় গড়ানোর সঙ্গে এই ভিড় বাড়তে থাকে। সবাই প্রিয় কবিকে শেষবার একনজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। দিনের আলো শেষ হতে, রাতে যখন কবির মরদেহ এল, সবাই যেন স্বজন হারানোর শোকে মুহ্যমান।

কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। নিজ এলাকায় কবি পিয়ারু মিয়া নামেই পরিচিত।

কবি আল মাহমুদ ’৫২- এর ভাষা আন্দোলনে গিয়ে ফেরারি হন। এরপর ১৯৭৪ সালে গণকণ্ঠের সম্পাদক থাকাকালে কারাবরণ করেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন।

চতুষপদী (সনেট) কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ কবি আল মাহমুদকে বাংলা সাহিত্যের অসামান্য স্থানে আসীন করে। এরপর থেকে তার প্রত্যেকটি লেখা যেন হয়ে ওঠে— আমি, আমার ও আমাদের কণ্ঠস্বর।

আল মাহমুদের রচনার মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, নদীর ভিতরে নদী, না কোনো শূন্যতা মানি না, বিরামপুরের যাত্রী, বারুদগন্ধি মানুষের দেশ, সেলাই করা মুখ, তোমার রক্তে তোমার গন্ধ ইত্যাদি।

কবির সাড়া জাগানো উপন্যাস কাবিলের বোন, পানকৌড়ির রক্ত, উপমহাদেশ, ডাহুকি, যেভাবে বেড়ে উঠি, আগুনের মেয়ে, যমুনাবতী, চেহারার চতুরঙ্গ, যে পারো ভুলিয়ে দাও, ধীরে খাও অজগরী ইত্যাদি।

সাহিত্যকর্মের জন্য আল মাহমুদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.