এক শাই হোপের কাছেই হেরে গেল বাংলাদেশ
ক্রিকেট দলীয় খেলা। কিন্তু দলীয় সেই আবরণের বাইরে কখনো কখনো হয়ে উঠে একক প্রদর্শনী। আজ মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেটি তারই সার্থক বিজ্ঞাপন হয়ে রইল। এক শাই হোপের কাছেই হেরে গেল বাংলাদেশ। হেরে গেল বাংলাদেশের দলীয় প্রচেষ্টা। অপরাজিত ১৪৬ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে হো একাই জেতালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ৪ উইকেটের এই রোমাঞ্চকর জয়ে দলকে সমতায় ফেরালেন সিরিজে। বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ২৫৫ রানের চ্যালেঞ্জ ২ বল বাকি থাকতেই টপকে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচটি রূপ নিল অলিখিত ফাইনালে।
মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ-বাংলাদেশের এই পঞ্চপাণ্ডবের একসঙ্গে এটা ছিল ১০০তম ম্যাচ। মানে উপলক্ষ্যটা ছিল দারুণ। প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ২৫৫ রানের পুঁজি উপলক্ষ্যটা রঙিন করবে বলেই মনে হচ্ছিল। কারণ মিরপুরের স্লো উইকেটে ২৫৬ রানের লক্ষ্যটা মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু ওই যে শাহ হোপ।
কেউ একজন এমন অতিমানবীয় ইনিংস খেললে ২৫৬ কি, ৩০০ রানের লক্ষ্যও কোনো ব্যাপার হওয়ার কথা নয়! ক্যারিবীয়দের এই জয়টা কতটা হোপময় সেটি ছোট্ট একটা তথ্যেই স্পষ্ট। দলের সংগ্রহ মোট ২৫৬। এর মধ্যে ১৪৬ রানই করেছেন হোপ একা। মানে বাকি সবাই মিলে করেছেন ১১০ রান। ক্যারিবীয়দের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংসটি মাত্র ২৭ রানের। যেটি খেলেছেন ড্যারেন ব্রাভো।
অথচ লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই উইকেট হারিয়ে বসে ক্রারিবীয়রা। হেমরাজকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের জয়ের আশাটা বড় করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু এরপর থেকেই ম্যাচটাকে বাংলাদেশের হাত থেকে বের করে নেওয়ার চেষ্টায় নামেন হোপ। যে পথে দ্বিতীয় উইকেটে ব্রাভোকে নিয়ে গড়েন ৬৫ রানের জুটি। এরপর মারলন স্যামুয়েলসকে নিয়ে আরও একটি ৬২ রানের জুটি। এরপর অবশ্য দ্রুত ৪ উইকেট তুলে নিয়ে খেলায় ফিরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ওই যে শাই হোপ!
বাংলাদেশের আশা ছিল শেষ দিকেও। কারণ শেষ ৩ ওভারে ক্যারিবীয়দের দরকার ছিল ৩২ রান। হাতে ৪টি উইকেট। রান বলেল সমীকরণ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু শাই হোপ সেটাকে মিলিয়ে দিলেন ক্যারিবীয়দের পক্ষে। রুবেলের করা ৪৮তম ওভারে নিলেন ১০ রান। এরপর মোস্তাফিজের করা ৪৯তম ওভারেই মূলত শেষ করে দেন ম্যাচ। ওই ওভারে ১৬ রান নিয়ে সমীকরণটা করে ফেলেন ৬ বলে ৬ রানের পানি-পানতা ব্যাপার।
৬ বলে ৬। উইকেটে ডেঞ্জারম্যান হোপ। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাডিফ তাই শেষ ওভারটি বাজি ধরলেন মাহমুদউল্লাহ দিয়ে। কিন্তু তার প্রথম ৪ বলেই ৬ রান নিয়ে হিসাবটা মিলিয়ে ফেললেন হোপ। জয়টা হোপ নির্ভরই। তবে শেষ দিকে তাকে যোগ্য সঙ্গ দেওয়ায় বিশেষ কৃতিত্ব পাবেন কেমো পলও।
কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৬ ষষ্ঠ উইকেট হারায় ১৮৫ রানে। মানে তখনো জয় থেকে ৭১ রান দূরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই জুটি ভাঙে পারলে তাই ম্যাচের ফলটা অন্য রকমই হতে পারত। কিন্তু হোপ তো নয়ই, বাংলাদেশি বোলাররা আউট করতে পারলেন না কেমো পলকেও। ৭১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে তারাই বরং মেতে উঠলেন জয়োৎসবে। এই ৭১ রানের জুটিতে কেমো পলের অবদান মাত্র ১৮ রান।
এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ তামিম, মুশফিক ও সাকিবের ফিফটিতে ৭ উইকেট হারিয়ে গড়ে ২৫৫ রানের পুঁজি। এমনিতে আধুনিক ক্রিকেটে ওয়োনডেতে ২৫৫ রানের স্কোর মামলিই। কিন্তু মিরপুরের স্লো উইকেটের কথা মাথায় রেখে পুঁজিটাকে আশা জাগানিয়াই মনে হচ্ছিল। আশা দিচ্ছিল প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশি বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংও। দুই দিন আগে এই মিরপুরেই প্রথমে ব্যাটিং করা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মোটে ১৯৫ রানে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশি বোলাররা।
ক্যারিবীয়দের জয়বঞ্চিত করতে আজ তার চেয়েও ৬১ রানের বেশি পুঁজি পেয়েছিল বোলাররা। কিন্তু এক শাই হোপের কাছে সেই পুঁজিও হয়ে গেল নস্যি। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশকে শুরুতেই পড়তে হয় উশানে থমাসের ঝড়ের মুখে। শুরুতে ছোট্টখাট একটা ঝড়ই তুলেন থমাস। ক্যারিবীয় তরুণ পেসারের সেই ঝড়ে শুরুতে এলোমেলোই হয়ে বাংলাদেশের ইনিংস। নিজের প্রথম এবং ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলেই বাংলাদেশ শিবিরে একটা ধাক্কা দেন থমাস। উইকেট নিয়ে নয়। ওপেনার লিটন দাসকে আহত করে হাসপাতালে পাঠিয়ে।
থমাসের ইয়র্কার লেন্থের বলটি ফ্লিক করতে গিয়ে পায়ে চোট পান লিটন দাস। সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচারে করে তাকে মাঠ ছাড়তে হয়। পরে এক্স-রের জন্য যেতে স্থানীয় এক ক্লিনিকে। বাংলাদেশের রান তখন ৯, লিটনের ৫। লিটনের আহত বিদায়ে ব্যাটিংয়ে নামে ইমরুল কায়েস। কিন্তু থমাসের পরের ভারে তিনি শুন্য রানেই আউট। লিটন হাসপাতালে, ইমরুল আউট। ফেলে শুরুতেই বিপদের শঙ্কা। তবে সেই বিপদ কাটিয়ে দলকে আলোর পথে ফিরিয়েছেন তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহীম।
দুজনে মিলে তৃতীয় উইকেট গড়েন ১১১ রানের জুটি। দলকে টেনে তোলার পর অবশ্য দুজনেই বিদায় নেন প্রায় গলাগলি ধরে। তবে তার আগে দুজনেই পূর্ণ করেন হাফসেঞ্চুরি। দেবেন্দ্র বিশুর শিকার হওয়ার আগে তামিম করেন কাটায় কাটায় ৫০। এই পথে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গড়েন তিন সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়ে ১২ হাজার রানের মাইলফলক। বর্তমানে তার আন্তর্জাতিক রান ১২০০৩।
তামিমের চেয়ে আরও ১২ রান বেশি করে মুশফিক আউট হন ৬২ রানে। রান করায় তাকেও টেক্কা দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। এক ছক্কা ও ৬ চারে তিনি ৬১ বলে করেছেন ৬৫ রান। এছাড়া উল্লৈখ্য করার মতো রান যা করেছেন মাহমুদউল্লাহ, ৩০।
হাসপাতালে যেতে হলেও আগেই জানা গেছে লিটনের চোট গুরুতর নয়। তার প্রমাণও মিলেছে। হাসপাতাল ঘুরে এসে দলের প্রয়োজনে ঠিকই আবার ব্যাট হাতে নেমে পড়েন লিটন। কিন্তু মাঠে নামার স্বস্তি দেওয়া পর্যন্তই। ব্যাট হাতে অবদান রাখতে পারেননি। ৫ রানের সঙ্গে আর মাত্র ৩ রান যোগ করে তিনি আউট হন ৮ রানে।
ক্যারিবীয় বোলারদের মধ্যে থমাসই সেরা। তিনি নিয়েছেন ৩টি উইকেট। এছাড়া একটি করে উইকেট নিয়েছেন কেমার রোচ, কেমো পল, বিশু ও রোস্টন চেস।
কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ম্যাচের একক নায়ক হয়ে থাকলেন শাই হোপ। ৩ ছক্কা ও ১২ চারে ১৪৪ বলে হার না মানা ১৪৬ রানের ইনিংস। ক্যারিয়ারে এর আগেও দুটি সেঞ্চুরি করেছেন। তবে আজকের এই ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটাকে আলাদাভাবেই মনে রাখবেন তিনি। মনে রাখবে ওয়েস্ট ইন্ডিজও। বাংলাদেশও কি নয়!