ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে খালেদার ‘ভিশন’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়েও বইছে ভোটের হাওয়া। চায়ের কাপে উত্তাপ ছড়াচ্ছে নির্বাচনী বিতর্ক।
পিছিয়ে নেই রাজনৈতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলা নবগঠিত জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের এই জোট ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করছে।
৬ সদস্যের একটি কমিটি এই খসড়া তৈরির কাজ করছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। বাকিরা হলেন, সাংবাদিক ড. মাহফুজ উল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী, ডা. জাহেদুর রহমান, শফিক উল্লাহ ও শফিকুল হক স্বপন।
বৃহস্পতিবার সকালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ধানমন্ডির অফিসে ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা প্রায় ২ ঘণ্টা বৈঠক করেন। সেখানে প্রত্যেক সদস্য নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। কমিটির সদস্য ড. মাহফুজ উল্লাহ বৈঠকে খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’ উত্থাপন করেন। পরে এটার উপর কমিটির অন্য সদস্যরাও আলোচনা করেন।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে মূলত প্রাধান্য পাচ্ছে বিএনপির কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’। এটি মুক্ত অবস্থায় ২০১৭ সালের মে মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। যদিও ইশতেহার নিয়ে জোটের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কিছু বলা হচ্ছে না।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে কী থাকছে, এমন আলোচনা এখন সবখানে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা এবার একটি ‘নতুন বাংলাদেশ, শান্তির বাংলাদেশ’ উপহার দিবেন। সে আলোকেই ইশতেহার প্রণয়ন করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির বৈঠকের আগে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আজ ইশতেহারের খসড়া তৈরিতে বৈঠক করব। খসড়া চূড়ান্ত হলে সেটি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি বৈঠক করে পাস করবে।’
ইশতেহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের চিন্তা আছে, মূল বিষয় থাকবে জাতীয় ঐক্য। অনেক হয়েছে, বিভক্তি আর নয়। কথা বলার অধিকার, গণমাধ্যমের অধিকার, আইনের সংস্কার, দেশের মেরামত দরকার। এগুলো চিন্তার মধ্যে আছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াই!’
ড. জাফরুল্লাহ আরও বলেন, ‘১১ দফার ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার হবে। তবে এটি আরও বিস্তৃত হতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যেই ইশতেহার ছাপানো হবে।’
জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি এবং ১১টি লক্ষ্যের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’ মিলিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া করা হচ্ছে।
পরে ইশতেহার বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দিতে চাই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটা জানি না। সেটি আলোচনা করে ঠিক করা যাবে। তবে এটা বলতে পারি সুন্দর বাংলাদেশ হবে।’
ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার কমিটির সদস্য প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বৈঠকে কমিটির সদস্যরা নিজেদের মতামত তুলে ধরেছি। খুব শিগগিরই একটা খসড়া তৈরি করে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির হাতে দেয়া হবে। তারা এটা চূড়ান্ত করবেন।’
২০১৭ সালের ১০ মে ‘ভিশন ২০৩০’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘শরতের আকাশে সাতটি রঙের বিচিত্র প্রভা নিয়ে রঙধনু যেভাবে মনোরম সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটায়। আমরা চাই, সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন ও পরিপুষ্ট করতে, যে সংস্কৃতি বাংলাদেশকে একটি Rain-Bow Nation (রঙধনু জাতি)- এ পরিণত করবে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে আমি ভিশন ২০৩০’র একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরেছিলাম। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশেষজ্ঞ ও দলীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। এখানেও পরিবর্ধন-পরিমার্জনের সুযোগ থাকবে। আশা করি, সবাই মিলে সফল হব।’
ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, মূলত খালেদা জিয়ার এই ভিশনের আদলেই নির্বাচনী ইশতেহার করা হচ্ছে। এখানে পরিবর্ধন-পরিমার্জন করা হবে।
কী ছিল খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য: রূপকল্পের সারসংক্ষেপে খালেদা জিয়া বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে, প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এর অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।
সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট: রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানী-গুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ: খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ করার লক্ষ্য নিয়ে এই রূপরেখা দেয়া হবে। তখন মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার মার্কিন ডলার। এজন্য বিএনপি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ডাবল ডিজিটে উন্নীত করার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ন্যায়পাল ও কার্যালয় সক্রিয়: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ‘ন্যায়পাল’ এর পদ এবং কার্যালয় সক্রিয় করা হবে।
সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তি: জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের সম্মতি গ্রহণের পন্থা ‘রেফারেন্ডাম’ বা ‘গণভোট’ ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করা। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সৃজনশীল, ইতিবাচক ও ভবিষ্যতমুখী এক নতুন ধারার সরকার ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা থাকবে। এজন্য নতুন এক সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তিতে উপনীত হতে উদ্যোগ নেবে বিএনপি।
আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় কানেকটিভিটি: খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াতে কানেকটিভিটি স্থাপন, সম্প্রসারণ ও জোরদার করতে বলিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া, কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি না করা, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সোহার্দ্য, বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা হবে।
জঙ্গি দমন: ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে দলটি। বিএনপি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বরদাশত করবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাও মেনে নেবে না।
বাতিল হবে সব কালা কানুন: নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন, পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হবে। সব কালা কানুন বাতিল করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আটক অবস্থায় দৈহিক-মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। আটকাবস্থায় মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার জন্য তদন্তের ব্যবস্থা থাকবে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতিসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবে বিএনপি।
শিক্ষা ব্যবস্থা: দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, মেয়েদের জন্য স্নাতক এবং ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হবে।
কৃষি ব্যবস্থা: কৃষকদের জন্য শস্যবীমা চালু, অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা হবে। সুষম, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যাস ও বিকশিত, কৃষিতে অনিরাপদ এবং ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহার বন্ধ করা হবে।
সূত্র: পরিবর্তন ডটকম