কাস্টমস ও এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগের সম্ভাব্য দুর্নীতির ১৯ উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৬ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতির সম্ভাব্য উৎস এবং তা নিরসনে সুপারিশ সম্বলিত ওই প্রতিবেদন ইতিমধ্যে দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সারোয়ার মাহমুদ কর্তৃক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে। এর আগে আয়কর বিভাগে দুর্নীতির ১৩টি উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৩ দফা সুপারিশ করছিল দুদক।
গত ৮ নভেম্বর আয়কর বিভাগের দুর্নীতির উৎস সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ওই সুপারিশও মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হয় বলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছেন। আর প্রতিবেদন দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি টিম তৈরি করার পর কমিশন কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়।
কাস্টমস ও এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট বিভাগের চিহ্নিত দুর্নীতির উৎসগুলো হলো-
১. পণ্য আমদানিতে পণ্যমূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই প্রকার পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণ ইত্যাদি কাস্টমস হাউজগুলোর ব্যাপক প্রচলিত অনিয়ম। উচ্চকর আরোপযোগ্য পণ্যসমূহের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে কম এবং নিম্নহারে কর আরোপযোগ্য পণ্যের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে বেশি দেখানো হয়। এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুসারে পণ্যাদি খালাস করা হয়।
২. রেয়াত সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন বা এসআরও এর শর্ত অমান্য এবং আমদানি-নীতি, পরিবেশ নীতি, অন্যান্য বিধি-বিধান ও নীতিমালার শর্ত/নির্দেশনা ভঙ্গ করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়ে থাকে।
৩. কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ এর বিধান অনুসারে আমদানিকৃত পণ্য এবং খালাসকৃত পণ্যের চালানসমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায়শ সমন্বয় করা হয় না। আমদানিকৃত মালামাল নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খালাস না হলে উক্ত মালামাল নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে এরূপ বিধান থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে যথা সময়ে এ ধরনের নিলাম অনুষ্ঠিত হয় না।
৪. কাস্টমসের জন্য বিশ্বব্যাপী এইসাইকুডা পদ্ধতি চালু থাকলেও বাংলাদেশে কাস্টমস বিভাগ সার্বিকভাবে এখনো এটি চালু করতে পারেনি। এ প্রেক্ষিতে কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াগুলো এখনো অস্বচ্ছ এবং সনাতন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে, যা দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
৫. প্রফর্মা ইনভয়েস, বিল অব লেডিং, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট এসব গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি আমদানিকারক বা এজেন্সি গুলো কর্তৃক প্রায়শ যথা নিয়মে সঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয় না। বিশেষত প্রফর্মা ইনভয়েসে আমদানি পণ্যের নাম, বর্ণনা, একক/পরিমাণ, গুণগতমান, মূল্য ইত্যাদি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় না। এ ধরনের বিচ্যুতি দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৬. কাস্টমস হাউজের বহুবিধ বন্ডসমূহের (শতভাগ রপ্তানি বন্ড/চামড়া খাতের বন্ড/আমদানি বিকল্প বন্ড/কূটনৈতিক বন্ডশিপ/স্টোরস বন্ড ইত্যাদি) ব্যবস্থাপনা মানসম্মত নয়। এতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভোগান্তি, কর ফাঁকি, দুর্নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
৭. সমজাতীয় বা প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ট্যারিফ কাঠামোর কারণে কাস্টমস সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৮. প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থের অপ্রতুলতা (অপর্যাপ্ত ওজন নির্ধারক/স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা, ফর্ক লিফ্ট, সমন্বিত স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন), কাস্টমস এর অন্তঃ ও আন্তঃ প্রাতিষ্ঠানিক (ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগ, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে) সমন্বয়ের অভাব, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ তৎপরতা, গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পণ্য খালাসের নিরীক্ষা সম্পাদনে অনীহা প্রভৃতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।
৯. অস্থায়ী আমদানি বিধির আওতায় বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত গাড়ি, লজিস্টিক্স ও অন্যান্য পণ্যাদি, বিলম্বিত শুল্ক ব্যবস্থার আওতায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত অনুরূপ মালামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং এরূপ প্রক্রিয়ায় আমদানিকৃত কোন কোন মালামাল পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়ে থাকে।
১০. ভ্যাট আইন ও বিধিমালায় অসঙ্গতি যথা: বিবিধ রেয়াত, মূল্য এবং ট্যারিফের নিন্ম ভিত্তি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিদ্যমান ভ্যাট সিস্টেম এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো এখনো সনাতন পদ্ধতির। এ ধরনের পদ্ধতি উত্তম চর্চাভিত্তিক ভ্যাট ব্যবস্থাপনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অনেক সময় রেয়াত গ্রহণের বিপরীতে সঠিক দলিলাদি থাকে না।
১১. পণ্যের শুল্কায়ন চূড়ান্তভাবে সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট আইনে সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক পণ্য ছাড় দেওয়ার বিধান রয়েছে। ফলে শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য চালান সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত শুল্কায়ন সম্পন্ন করা হয় না। এভাবে দেশের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।
১২. কাস্টমস হাউজগুলোতে ওজন পরিমাপক যন্ত্র, স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা প্রতিনিয়তই অকেজো থাকে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অকেজো করে রাখা হয় মর্মে অভিযোগ আসে। এই সুযোগে অনেক উচ্চ শুল্ক হারের পণ্য কিংবা ক্ষেত্রে বিশেষে আমদানি-নিষিদ্ধ পণ্যাদি খালাস করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকিসহ আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম বিনষ্ট হয় এবং দুর্নীতি সংঘটিত হয়।
১৩. সিএন্ডএফ এজেন্টদেরকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সঠিকভাবে মনিটরিং না করার ফলে দুর্নীতিবাজ শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে সিএন্ডএফ এজেন্টেদের অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। ফলে দেশের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি সুবিধাভোগী দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়।
১৪. বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়মিত অডিট সম্পন্ন করা হয় না; বিশেষ করে ইউটিলাইজেশন ডিকলারেশন আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে, যা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে অডিট করে না।
১৫. বন্ড লাইসেন্স প্রদানে এবং নবায়নে দুর্নীতি ঘটে। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্যতা বাড়িয়ে/মূল্য কমিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো শুল্কমুক্ত মদ এবং অন্যান্য পণ্যাদি আমদানিপূর্বক তা ভুয়া প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামে বিতরণ দেখিয়ে খোলাবাজারে বিক্রয়পূর্বক দেশের রাজস্ব ক্ষতি সাধন করা হয়। একইভাবে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রকৃত প্রাপ্যতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রাপ্যতা দেখানো হয় এবং বেশি প্রাপ্যতাকে ধরেই লাইসেন্সে নবায়ন করানো হয়।
১৬. আমদানি রপ্তানিতে এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড এর অংশটুকু ব্যতিরেকে বন্ড ওয়্যারহাউস কার্যক্রমের ব্যস্থাপনা সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালী সম্পাদিত হয়। নতুন লাইসেন্স ছাড়া আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম সমন্বয় কিংবা অডিট প্রক্রিয়াটি অত্যাধিক কাগুজে দলিল নির্ভর যার অনেক তথ্য যাচাই বাছাই করার অবকাশ থাকে। ফলে, এ পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন অডিট সম্পদান করা প্রায় অসম্ভব। যার সুযোগ বন্ড প্রতিষ্ঠান এবং অসাধু কর্মকর্তারা গ্রহণ করে থাকে।
১৭. বর্তমান মূসক ব্যবস্থায় আদর্শ হারে ১৫% হারে মূসক, ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত মূল্যে মূসক পরিশোধের বিধান রয়েছে। ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত ভিত্তি মূল্যে পণ্য/সেবা প্রদানকারীর রেয়াত গ্রহণ করতে না পারায় তারা কাঁচামালের ওপর ভ্যাট পরিশোধ হয়েছে কি না-তা যাচাই করে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কাঁচামাল ক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে মূসক ফাঁকি দিয়ে থাকে।
১৮. উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয়ের ফলে ভ্যাটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত শ্রম প্রদানের প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে তাদের লক্ষ্যমাত্রা উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হওয়ায় তারা ভ্যাটের পরিধি বাড়িয়ে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন না করে দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে যায়। এছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের সাথে অবৈধ যোগসাজশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালান (মূসক-১১) জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহককে প্রতারিত করার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।
১৯. শুল্ক ও ভ্যাট আদায় সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকা এবং নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতিতে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এর অভাবে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।
এসকল দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৬ সুপারিশ দিয়েছে দুদক।