জামায়াত বিলুপ্ত চেয়ে দল ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক
জামায়াতে ইসলামীর জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা এই আইনজীবী নেতা দলের আমির মকবুল আহমাদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে শুক্রবার খবর দিয়েছে বিবিসি বাংলা।
এতে বলা হয়, আব্দুর রাজ্জাক তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন। দাবি করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি চেষ্টা করেছেন, যাতে একাত্তরের ভূমিকার কারণে দলটি জাতির কাছ ক্ষমা চায়।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী যুক্তরাজ্যের এসেক্সের বারকিং থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। এতে তিনি বলেছেন, ‘দলীয় ফোরামে একাত্তর ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামকে বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু, সেটি গৃহিত না হওয়ায় হতাশা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু, সে দাবি অনুযায়ী জামায়াত নিজেকে এখন পর্যন্ত সংস্কার করতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতৃবৃন্দ ’৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেনি। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেনি।’
লন্ডন যাওয়ার আগে পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সে সময়ে গ্রেপ্তার জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দলটির বেশিরভাগ মামলা পরিচালনাকারী এই আইনজীবী বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল স্বীকার করে জাতির সঙ্গে সে সময়ের নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার অবস্থান নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ১৯৮৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাতারে আসেন। দলে তার প্রজ্ঞার সঙ্গে নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতাও বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়েছে।
পদত্যাগপত্রে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘গত প্রায় দুই দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ’৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগ পত্রে বলেন, ‘কিন্তু, দলটির এসব অসামান্য অবদান ’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে স্বীকৃতি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সব সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘২০০১ সালে জামায়াতের সে সময়ের আমির এবং সেক্রেটারি জেনারেল মন্ত্রী হওয়ার পর বিজয় দিবসের আগেই ১৯৭১ নিয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন একটি কমিটি এবং বক্তব্যের খসড়াও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।’
এ ছাড়া ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়েও জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন বলে পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন আব্দুর রাজ্জাক।
পরে ২০১১ সালে মজলিসে শুরার সর্বশেষ প্রকাশ্য অধিবেশনেও তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু, দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের অবহেলায় তার প্রস্তাব পরাজিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এরপর ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বর্তমান আমির মকবুল আহমাদকেও চিঠি পাঠিয়ে ১৯৭১ প্রসঙ্গে বক্তব্য দেয়ার প্রস্তাব দেন আব্দুর রাজ্জাক।
মকবুল আহমাদ আমির হওয়ার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মতামত চাইলে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া সংক্রান্ত একটি খসড়া বক্তব্য পাঠান। কিন্তু, সেটিও আর বাস্তবায়িত হয়নি।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেই। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন। কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’
পদত্যাগপত্রে তিনি বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা ও একাত্তরে দলের ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে যে প্রভাব, তাও তুলে ধরেছেন দলের আমিরের কাছে।
আব্দুর রাজ্জাকের ভাষায়, জামায়াতে যোগ দেয়ার পর তিনি দলের ভেতর থেকে সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ‘বিগত ৩০ বছর আমি সেই চেষ্টাই করেছি। আমি কাঠামোগত সংস্কার ও নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলাম। ২০১৬ সালে চিঠি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। অন্য মুসলিম দেশগুলোর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু, কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দলের সর্বশেষ পদক্ষেপ তাকে হতাশ করেছে বলেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’