ঢাকায় অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে জামায়াত

137

দেশের সবচেয়ে জনবহুল জেলা ঢাকা। দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানেও ভোটের লড়াইয়ে নামে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু বিজয়ীর হাসি কখনোই হাসতে পারেননি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলটির প্রার্থীরা; বরং শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তাঁদের। তবু সংসদ নির্বাচনে ঢাকা জেলার কোনো না কোনো আসন থেকে জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেটি কখনো জোট বেঁধে, কখনোবা একক প্রার্থী দিয়ে।

05e7adc62ecd42cb01fdf200a543f8d0-5c1f17fc0b88c

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা জেলা থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীসংখ্যা কমে এসেছে। নিবন্ধন না থাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০–দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা।

সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৫ আসনে দলটির প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-১৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। কাফরুল, মিরপুর ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকার কিছু অংশ নিয়ে গড়া এই আসনে জামায়াতের শীর্ষ নেতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কামাল আহমেদ মজুমদার। প্রচারে আর পোস্টারে নৌকা প্রতীকে তিনবারের সাংসদের দেখা মিললেও শফিকুর রহমানকে মাঠে দেখা যায়নি। তবে শীর্ষ নেতাকে প্রার্থী করে দীর্ঘ ২২ বছর পর সংসদ নির্বাচনের ঢাকা জেলার ভোটযুদ্ধে ফিরে এসেছে জামায়াতে ইসলামী।

ঢাকা-১৫ আসনের এলাকাবাসীর মতে, দৃশ্যমান প্রচার না থাকলেও রাজধানী মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রার্থী দিয়ে জামায়াত ইসলামী তাদের অস্তিত্বের বার্তা দিচ্ছে।
প্রচারের কৌশল
কাফরুলের ইব্রাহিমপুর থেকে শেওড়াপাড়া, মণিপুর, কাজীপাড়া, পীরেরবাগের মতো সব এলাকাতেই নৌকা প্রতীকের পোস্টার–ব্যানারের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর হাতপাখা প্রতীকের পোস্টার রয়েছে। কিন্তু বিশাল এই এলাকা ঘুরে কোথাও ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী শফিকুর রহমানের একটি পোস্টারও দেখা যায়নি। এলাকায় যেসব বাসিন্দার সঙ্গে কথা হলো, তাঁরা কেউ ধানের শীষের কোনো পোস্টার দেখেছেন কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

তবে নৌকা প্রতীকের সবর প্রচারণা থাকলেও জামায়াতে ইসলামী ধানের শীষ নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে বেশ নীরবে। দিনের বেলা ময়দানে দেখাই যায় না তাদের নেতা-কর্মীদের। রাতের বেলা কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে প্রচার চালান জামায়াত কর্মীরা। ১০ থেকে ১২ জনের ছোট ছোট দল করে এলাকাভিত্তিক লিফলেট বিতরণ করেছেন তাঁরা। প্রতিটি দলে দু-তিনজন বয়স্ক লোক থাকেন। বাকি সবাই বয়সে বেশ তরুণ। মসজিদের সামনে কিংবা বাজারগুলোয় খুব দ্রুত লিফলেট বিতরণ করেছেন। এলাকা ভাগ করা থাকলেও জামায়াত প্রার্থীর লিফলেট বিতরণ হয় নির্দিষ্ট সময়ে। ১৪ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইব্রাহিমপুর বাজার, পীরেরবাগ শিমুলতলা মসজিদের সামনে এশার নামাজের পর লিফলেট বিতরণ করেছেন জামায়াত কর্মীরা। কিন্তু এলাকার কিছু লোকজন এগিয়ে এলে দ্রুত সেখান থেকে সরে যান তাঁরা। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও লিফলেটে খালেদা জিয়ার ছবি নেই। লিফলেটে রয়েছে কেবল শফিকুর রহমানের ছবি আর ধানের শীষ প্রতীক।

অবশ্য লিফলেট বিতরণে নিজেদের প্রচার সীমিত রাখছে জামায়াতে ইসলামী। ডিজিটাল কৌশল অবলম্বন করেছে তারা। এলাকাভিত্তিক ভোটারদের কাছে মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হচ্ছে। যেখানে লেখা, ‘খালেদা জিয়ার সালাম নিন, ডা. শফিকুর রহমানকে ধানের শীর্ষে ভোট দিন।’ ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে ইব্রাহিমপুর এলাকায় ডা. শফিকুর রহমানের নাম উল্লেখ করে এ ধরনের এসএমএস পাঠানো হয়। নিবন্ধন না থাকায় লিফলেট বা এসএমএসে জামায়াতে ইসলামী উল্লেখ ছিল না।

হামলার অভিযোগ
দৃশ্যমান প্রচার-প্রচারণা না থাকলেও জামায়াতে ইসলামী বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছেন কাফরুল-মিরপুর থানার আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরা। ১৮ ডিসেম্বর রাতে মণিপুরের মোল্লাপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগে প্রচারকেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দলের একজন নেতা আহত হন। এশার নামাজের পর এই হামলায় নৌকার পোস্টার, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী ছবি ছিঁড়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন তাঁতীলীগের নেতা মোশারফ হোসেন। এরপর ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির জানান, গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে বেশির ভাগই জামায়াতের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা–কর্মী। এ ছাড়া বিএনপির কয়েকজন কর্মীও রয়েছেন।

পরদিন ১৯ ডিসেম্বর এশার নামাজের পরও ১৪ নম্বর সেকশনের বড় মসজিদের সামনে কামাল মজুমদারের একটি প্রচারকেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায়ও জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে কাফরুল থানায় একটি মামলা করে আওয়ামী লীগ।

তবে ১৮ ডিসেম্বরের হামলার ঘটনার নিন্দা জানান জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। গত বুধবার পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই ধরনের হামলা কাপুরুষোচিত কাজ। একটি মহল নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। নির্বাচনী পরিবেশকে স্থিতিশীল করতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শফিকুর রহমান।

২০ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর শফিকুর রহমানের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রতিদিন প্রচারকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক কর্মীকে আটক করা হয়েছে। গতকাল থেকে আমাদের একজন নির্বাচন সমন্বয়ককে খুঁজে পাচ্ছি না। আওয়ামী লীগ ও পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জনগণ আমাদের পক্ষে। ৩০ ডিসেম্বর জনতার ভোটবিপ্লব ঘটবেই ইনশা আল্লাহ।’

ঢাকা-১৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
চার নির্বাচনে জামায়াতের ভোট সোয়া লাখ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ বা একক—দুভাবেই ভোটের লড়াইয়ে নামে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটি নিষিদ্ধ থাকায় ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী জোট করে মুসলিম লীগের সঙ্গে। ওই নির্বাচনে ঢাকা জেলার মধ্যে চারটি আসনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে তাদের প্রার্থী ছিল। এর একটি আসনেও জয় পাননি তাঁরা। এর মধ্যে ঢাকা-৩ আসনে ৭ হাজার ২৭৭ ভোট পেয়েছিল জামায়াত। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ঢাকা থেকে একটি আসনে প্রার্থী দেয় জামায়াতে ইসলামী। সেবার ঢাকা-৬ আসনে (মতিঝিল) ১২ হাজার ৭১৫ ভোট পান দলটির প্রার্থী। এটি ঢাকা জেলায় জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি ভোট। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ঢাকা জেলার ১৩টি আসনের মধ্যে ৯টি আসনে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছিল। সেবার ঢাকা-৬ আসনে জামায়াতে ইসলামী তখনকার ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান ১০ হাজার ১০৪ ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। ঢাকার ১৩টি আসনের মধ্যে ঢাকা-১১ আসন (বৃহত্তর মিরপুর) থেকে সবচেয়ে বেশি ৮ হাজার ৯৪৬ ভোট পেয়েছিল। এরপর বিএনপির জোটসঙ্গী থাকায় ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা জেলায় কোনো প্রার্থী ছিল না জামায়াতে ইসলামীর। সবশেষ ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচন বিএনপির মতো তারাও বয়কট করে। তবে নির্বাচনে কমিশনে নিবন্ধন না থাকা জামায়াতে ইসলামী এবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। সব মিলিয়ে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ২৩ প্রার্থী পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ ভোট।

২২ বছর পর ঢাকার নির্বাচনে ফিরে আসা জামায়াত ইসলামী এবার অন্য হিসাব–নিকাশ করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা এবার ভোট বেশি পাবেন বলে মনে করছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভোট পাওয়ায় আগের হিসাব চলবে না। এখানে প্রতীকের একটি বিষয় আছে। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন হলে অ্যান্টি–আওয়ামী লীগের ভোট ধানের শীষে চলে আসবে।

এবারের নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দলটিকে আবার জাগিয়ে তোলা হলো বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ধানের শীষ প্রতীক পেয়ে জামায়াত এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তাদের প্রার্থীরা বলছে, খালেদা জিয়ার সালাম নিন, তাদের অমুক প্রার্থীকে ভোট দিন। বিএনপি আগে বলত, তাদের (জামায়াতে ইসলামী) সঙ্গে আদর্শগত মিল নেই। ধানের শীষ প্রতীক জামায়াতকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই বাধা আর থাকল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে জামায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই নিশ্চিহ্ন জামায়াতকে আবার জাগিয়ে তুলল বিএনপি।’

সূত্র: প্রথম আলো।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.