তারণ্যের বিজয় না পরাজয়
নিউজবিডিইউএস:এইত গেল কয়েকদিনে দেশের তরুণ সমাজের সবচেয়ে কাঙ্খিত নিরাপদ সড়ক এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার একটি আন্দোলন হয়ে গেল। তাদের এই আন্দোলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশবাসী সকলেই তরুণদের সমর্থন জানিয়েছেন। এরপর যা হল তা সবারই জানা…..। যে কোনো আন্দোলনের জয়-পরাজয় আছে এটা সবারই জানা। ফলে এই আন্দোলনে কোন পক্ষ হেরেছে আর কে জিতেছে সেটা নিয়ে কোনো কথা নয়। তরুণদের আন্দোলনটি যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে এতে মোটামোমোটিভাবে সবাই একমত। আর এই আন্দোলন যে বিশ্ববাসী বিশেষ করে বাংলাদেশিদেরকে একটা অর্থপূর্ণ বার্তা দিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই আন্দোলন ঘুম ভাঙিয়ে জাতিকে জাগ্রত করেছে, নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জাতিকে প্রতিরোধের ভাষা শিখিয়েছে। ফলে এ অর্জন একেবারে কম নয়। তবে কোনো ধরনের সহিংসতা আমাদের কাম্য নয়।
আমরা জানি, প্রতিটি শিশুর মনেই দেশপ্রেম ও মানবসেবার স্বপ্ন লুকায়িত থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সেটা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে। তাই শিশুকিশোরদের ‘ভবিষ্যতে কী হবে?’ প্রশ্ন করা হলেই শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগই উত্তর দিয়ে থাকে চিকিৎসক হয়ে দেশ ও মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে । এরপর হয়তো প্রকৌশলী, পাইলট ও শিক্ষক হবার স্বপ্নের কথা বলে। এই যে শতকরা ৯৯ ভাগ শিশুকিশোরের স্বপ্ন, সেটা কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকেই নিয়ে আসেনি, কিংবা এমনিতেই জাগ্রত হয়নি। এর পেছনে আমাদের পরিবেশ ও বড়দের একটা প্রভাব রয়েছে। অবশ্য দেশ কিংবা মানবসেবার মতো ভাল স্বপ্ন দেখা দোষের কিছু নয়; কেননা, স্বপ্নই প্রতিটি মানুষকে বড় করে। পরবর্তীতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।
ফলে নিরাপদ সড়ক এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তরুণদের মনে বীজ বপন হয়েছে তাতে বাংলাদেশকে আমি একটি নতুন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অবলোকন করছি। এই বীজ একদিন অঙ্কুরিত হবেই, একে কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখা যাবে না।
তরুণরা যে স্বপ্ন নিয়ে সাম্প্রতিক মোভমেন্টটি করল এতেই লুকিয়ে আছে একটি স্ব্চ্ছ-সুন্দর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। এতেই লুকিয়ে আছে একটি নেশা ও বেকারত্বমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ গড়ার অঙ্গিকার। এমন একটি নাড়া দেয়ার পরিবেশ অনেক আগেই তৈরি হয়েছে, কিন্তু তরুণদের ঘুম থেকে জাগ্রত অনেক দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণে অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার।
আজ লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত মেধাবী তরুণ বেকার মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং সম্ভবত তা বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। আর এর পিছনে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার অবদান মোটেই কম নয়। কেননা, ‘পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রযুক্তিদক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে আমরা তখন তৈরি করছি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার। এ সংখ্যাটা একেবারেই কম নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩০ লাখ তরুণ। জীবনের চরম বাস্তবতা তাদের পিছু ছাড়ছে না। মুহূর্তে তাড়া করছে চাকরি না পাওয়ার হতাশা। এই হতাশার কারণে ঈদে কিংবা অন্য কোনো জাতীয় দিবসেও আমাদের তরুণদের মাঝে নেই কোনো আনন্দ–উচ্ছ্বাস ।
আইএলও, বিশ্বব্যাংক, উন্নয়ন গবেষণাসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের প্রায় অর্ধেকই বেকার এমন তথ্য উঠে এসেছে। ইকোনমিস্ট-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার বলে জানানো হয়। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিকীকরণ এবং পরীক্ষার ফল নিয়ে রাজনীতিকরণ তরুণদের কমজোর করে দিয়েছে। এই যে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে, এর দায় কার? রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পাড়ে না।
অথচ আমরা সবাই জানি ‘তরুণরাই যে কোনো জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি’,। আজকের তরুণরাই দেশ ও জাতীর ভবিষ্যৎ। কাজেই তরুণদের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্খা ও তাদের উদ্যম এবং মেধা নান্দনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ সমাজের মেধা, শক্তি, সাহস ও প্রতিভাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় একটি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি তথা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি। কিন্তু আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য, এই তরুণ সমাজকে ক্রমেই হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। জাতিকে ধ্বংস করার মত এর চেয়ে আর কি প্রক্রিয়া হতে পারে!
নিবন্ধে এত কিছু উল্লেখ করেছি বলেই আমি হতাশাদের দলে নই। তাই তরুণেদর উদ্দেশ্যে বলবো- ঘুম থেকে জাগতে হবে, নতুন দিনের শুভ সুচনা করতে হবে। আর কতকাল আমরা অসৎ পরায়ন রাজনীতিবিদের উপর নির্ভর করে থাকব? উজ্জীবিত শক্তি ছাড়া কোনো জাতিই অগ্রসর হতে পারে না। দুর্বার গতিতে বিশ্বকে জয় করাই তারুণ্যের ব্রত। তারুণ্য পরিবর্তনকামী। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে যেন। জয়ের স্বপ্ন-অভয়কে প্রশ্রয় দেয়ায় যেন তারুণ্যের সার্থকতা।
সবশেষে, তাই নজরুলের ভাষায় বলতে চাই- পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। তাই হে তরুণ সমাজ জেগে উঠ, বিজয় তোমাদের হবেই হবে।