নাম বদলাচ্ছে জামায়াত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও কমবে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর যে ভূমিকা ছিল, তা এখনও দলটির ভবিষ্যত নির্ধারণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়া দলটি এখন অতীতের উত্তরাধিকার থেকে বেরিয়ে আসতে নাম পরিবর্তন সহ নানা বিকল্প বিবেচনা করছে।
জামায়াতের নেতারা বলছেন, বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে দলের নাম পাল্টানোসহ বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।
নাম পাল্টানো ছাড়াও অন্য যে বিকল্পের কথা বিবেচনায় আছে তা হলো ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বেশি করে সক্রিয় হওয়া।’
দলটির ভেতরকার বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এরকম আভাস মিলেছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের বলছিলেন, নানা বিকল্পের মধ্যে দলটির নাম পরিবর্তন করে একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রস্তাব পেয়েছেন তারা।
“আমাদের নাম পরিবর্তন বা কিছু কর্মকৌশল পরিবর্তনের বিষয়ে এবং নতুন করে অন্য কোনো সামাজিক বা স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান করা যায় কিনা, ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের নানা সার্কেল থেকেই পরামর্শ আসতেছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি আসতেছে” – বিবিসি বাংলাকে বলেন ডা. তাহের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যত করণীয় ঠিক করতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে জামায়াত। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসা না আসার প্রশ্নে আলোচনাতেও দলটির অতীত প্রাধান্য পাচ্ছে।
এই বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার এবং সাজা হয়েছে, কিন্তু তার পরও ১৯৭১ সাল এখনও তাড়া করছে জামায়াতে ইসলামীকে।
দলটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই ভূমিকার জন্য এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি।
১৯৭১-এর সেই ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে জামায়াতে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
দলটিতে নতুন করে এই ইস্যু আলোচনায় এলেও এখনো পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য আসছে বলে জানিয়েছেন জামায়াতের সিলেট মহানগরীর আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়ের।
তিনি বলছিলেন, “এ বিষয়টা এখন সেটেল হয়ে গেছে। এরপরও পরামর্শ আসছে, এ বিষয়ে জামায়াতের কোনো বক্তব্য দেয়া উচিত কিনা, এটা নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে।”
এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে ক্যাডারভিত্তিক দল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অবস্থান তৈরি করেছে, কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থন তাদের মিলছে না।
গত ১০ বছরে জামায়াতের এই সমস্যা এখন অস্তিত্বের সংকটে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তারা দলীয় প্রতীক হারিয়েছে। অনেকটা গোপন দলের মতো তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সম্প্রতি জামায়াতের নির্বাহী কর্মপরিষদ এবং শুরার বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে জামায়াতের নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম নিয়ে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুক্তি দিয়ে দলটির অনেকে প্রস্তাব এনেছেন।
কিন্তু সব প্রস্তাবের ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলটির অতীত।
ডা.আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলছেন, নাম পরিবর্তনের কথা দলের ভেতরে অনেকেই বলছেন।
“কেউ ভাবছে, নাম পরিবর্তন করলেই ভাল হবে নতুন প্রজন্মের জন্য। আবার কেউ দীর্ঘদিনের জামায়াতের যে ইতিবাচক ভূমিকা বা এই নাম নিয়ে জনগণের সাথে যে সম্পৃক্ততা বা গ্রহণযোগ্যতা – এসব নিয়েই আবার কারও কারও মত হল এটাই কল্যাণকর হবে। এ রকম এক ধরণের ক্রিটিক্যাল আলোচনা চলছে” – বলেন ডা. তাহের।
যদিও দলটির নেতাদের অনেকে ভাবছেন, জামায়াতে ইসলামী নাম নিয়ে তাদের সব সময় বিতর্ক বা চাপের মধ্যে থাকতে হয়, ফলে তা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতা যাদের ফাঁসি হয়েছে বা বিচার হয়েছে, তাদের পরিবারগুলোর আবেগের বিষয়কেও বিবেচনায় নিয়ে অন্য অনেকে ‘দলের পুরোনো নাম বহাল রাখার পক্ষে’ই যুক্তি তুলে ধরছেন।
বিএনপির সাথে জামায়াতের জোট নিয়েও নানা প্রশ্ন
এদিকে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসার বিষয় নিয়েও জামায়াত আলোচনা করেছে।
গত ৩০শে ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে জামায়াত, বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এরপরও দলটির অনেক নেতা মনে করেন, বিএনপি জামায়াতকে যথাযথ মূল্যায়ন করেনি।
ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের বলছিলেন, ঐ জোট এখন প্রাসঙ্গিক নয় বলে তারা মনে করেন।
তিনি বলেন, “জামায়াত যেটা এখন মনে করে যে, বিএনপি যেহেতু আরেকটা ফ্রন্টে এখন সক্রিয়, সেদিক থেকে ২০দলীয় জোটকে আমরা এখন অনেকটাই অকার্যকর দেখছি।এরকম একটা অকার্যকর জোটে থাকা না থাকার ব্যাপারে আমরা খুব আগ্রহ দিতে চাই না।”
তবে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর মনে করেন, জামায়াত একলা চলতে চাইছে এবং সেভাবেই এগুবে। একই সাথে তারা জোট ভাঙার দায় নিতে চায় না।
“এখন বিএনপি মনে করে যে, তারা জামায়াতকে আশ্রয় দিচ্ছে। এ বিষয়টি জামায়াত গ্রহণ করে না। এজন্য জামায়াত এখন চাচ্ছে, বিএনপি যদি জামায়াতকে ভার মনে করে, তাহলে তারা সেই ভার মুক্ত করে দিক। বিএনপির একটা অংশ জামায়াতকে অ্যালার্জি মনে করে, সেই অনুভূতি জামায়াত অসন্মানজনক মনে করে। জামায়াত একলা চলতে চায়,” – বলেন মি. বাবর।
এদিকে জামায়াতের সাথে সম্পর্কের কারণে বিএনপিকেও দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
এবার নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর বিএনপির নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
তবে বিএনপিও সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলছিলেন, জামায়াত জোট থেকে বেরিয়ে গেলে বিএনপির জন্য লাভ লোকসান দু’টিই আছে।
“বিএনপির একটা ভাবমূর্তি আছে যে তারা জামায়াতের সাথে জোট করেছে – যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে । সেই যে একটা খারাপ ইমেজ সেটা অনেকাংশে কমে যাবে। কিন্তু ভোটের হিসাবনিকাশে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে,” – বলেন দিলারা চৌধুরী।
তবে জামায়াত নেতারা বলছেন, এখন তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণে যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, সেগুলোতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তাদের অনেক সময় প্রয়োজন হবে।