নিউইয়র্কে বাফা’র উদ্যোগে চিত্রাঙ্গদার সফল মঞ্চায়ন
নিউইয়র্ক (ইউএনএ):
বাংলাদেশ একাডেমী অব ফাইন আর্টস ‘বাফা’র উদ্যোগে নিউইয়র্কে মঞ্চস্থ হলো ‘বিশ্ব কবি’ খ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরায়ত সৃষ্টি নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়ন করা হয়। গত ২৪ নভেম্বর শনিবার বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের ফ্লাশিং এর কুইন্স থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়। এর মূল নির্দেশনায় ছিলেন বাফা’র নৃত্যগুরু অনুপ কুমার দাস। মজার ব্যাপার হলো প্রবাসের দর্শক-শ্রোতা দীর্ঘদিন পর টিকিট কেটে হলে ঢুকে নাটকটি উপভোগ করেছেন। দর্মক-শ্রোতায় হল ছিলো পূর্ন। নিউইয়র্ক শহরে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চায় আবারো বাফা’র সফলতার প্রমাণ মিললো হল ভর্তি দর্শকদের উপস্থিতিতে। শিশু-কিশোর সহ সকল অংশ গ্রহণকারী শিল্পীদের প্রাণবন্ত পরিবেশনা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন হল ভর্তি দর্শক। খবর ইউএনএ’র।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা। তিনি বাফা’র এই সাহসী প্রযোজনাকে অভিনন্দন জানান। এছাড়াও জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন তারেক মুহাম্মদ আরিফুল হক।
নাট্য পরিচালক অনুপ কুমার দাশ তার বক্তব্যে এই নাটকের সফল মঞ্চায়নের জন্য শিল্পীদের মা-বাবার প্রতি কৃতিত্ব জানিয়ে বলেন, যারা দিনের পর দিন মহড়ায় এসে শিল্পীদের সঙ্গ দিয়েছেন তাদের জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, নিউইয়র্কে তার পরিচালনায় এটি তৃতীয় প্রয়াস এবং সবচেয়ে সফল মঞ্চায়ন বলে উল্লেখ করেন।
বাফা’র সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন তার বক্তব্যে বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও হলে এসে নাটক দেখতে আসায় সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, দর্শকদের ব্যাপক সাড়া পেয়ে আমরা অভিভূত। প্রবাসের দর্শকরা যদি তাদের এই সমর্থন অব্যাহত রাখেন তাহলে আগামীতে আমরা আরো ভালো কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করবো।
অনুষ্ঠানটি নান্দনিকভাবে উপস্থাপনা করেন শামীম আরা বেগম ও গোলাম মোস্তফা এবং ধারা বর্ণনায় ছিলেন আনোয়ারুল হক লাভলু। পরিচালনা এবং ইভেন্ট কো অর্ডিনেটরের দ্বায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ফরিদা ইয়াসমীন ও ফারজানা ইয়াসমিন।
নাটকের কাহিনীতে দেখা যায় মহাবীর অর্জুন সত্য পালনের জন্য একযুগ ব্রহ্মাচার্য ব্রত গ্রহণকরে মনিপুর বনে আসেন। মনিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের প্রেমে উদ্বেলিত হলেও অর্জুন রূপহীন চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করেন। অপমানিত চিত্রাঙ্গদা প্রেমের দেবতা মদন ও যৌবনের দেবতা বসন্তের সহায়তায় এক বছরের জন্য অপরূপ সুন্দরীতে রূপান্তরিত হন। অতপর: অর্জুন তার ব্রত ভেঙ্গে চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। কিন্তু ক্রমশ: চিত্রাঙ্গদার মধ্যে দ্বৈত সত্ত্বার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এজন্য যে, অর্জুন প্রকৃতপক্ষে কাকে ভালোবাসে- চিত্রাঙ্গদার এই এক বছরের জন্য পাওয়া রূপকে না প্রকৃত অস্তিত্বকে। এমন দ্বন্দ্বে চিত্রাঙ্গদার সাথে উপস্থিত হল ভরা দর্শকরাও বিচলিত হয়ে উঠেন। ঘটনা পরম্পরায় চিত্রাঙ্গদার নতুন রূপের সময়সীমাও প্রায় শেষ দিকে এসে হাজির হয়। নির্দিষ্ট সময়ের শেষ রাতে চিত্রাঙ্গদার এই নতুন রূপ বসন্ত দেবের অক্ষয় ভান্ডারে চলে যায়। অতপরঃ অবগুণ্ঠনে ঢাকা চিত্রাঙ্গদা যখন তার অবগুণ্ঠন খুলে অর্জুনের সামনে দাঁড়ায় এবং বলে- ‘আমি চিত্রাঙ্গদা, দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমনী।… শুধু নিবেদি চরণে, চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্র নন্দিনী।” এতে বিস্ময়াবিভূত অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে- ‘প্রিয় আজ ধন্য আমি’। আর এভাবেই যবনিকাপাত হয় নাটকের।
নাটকে জয় হয় চিত্রাঙ্গদার। জয় হয় নারীর, জয় হয় প্রেম আর মানবতার। রবীন্দ্রনাথ জীবনের নানা প্রান্তে নারী ভাবনায় আবর্তিত হয়েছেন। নারীর ভেতরে তিনি অজেয় মনের সম্ভাবনার সৌন্দর্য্য অন্বেষণ করেছেন। তার নৃত্যনাট্যগুলিতে নারী মুক্তির ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব সাধন করেছেন। প্রেম ও কর্ম শক্তির সমন্বয়ে নারীর ভেতর কল্যানীরূপের সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর বাফা সে রূপটাকেই ছড়িয়ে দিয়েছে প্রবাসে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে। সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে প্রবাসের আরেক গুনী শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের কণ্ঠে। তিনি নাটক দেখার পর মঞ্চে উঠে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘এই প্রবাসে আমরা নৃত্যনাট্যকে ভুলে যেতে বসেছিলাম বাফা আমাদের তা মনে করিয়ে দিচ্ছে’।
উল্লেখ্য, বাফা ইতোপূর্বে নিউইয়র্কে সফল মঞ্চায়ন করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্য দুটি নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা ও মায়ার খেলা। বলা বাহুল্য তাদের দুটো পরিবেশনাই দর্শক নন্দিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও সফল মঞ্চায়ন হলো এই চিত্রাঙ্গদা। নাটকটির কাব্যময়তা, নির্দেশনা, দৃশ্য-কল্প নির্মাণ, মঞ্চ সজ্জা ও আলোর ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করেছে। মুগ্ধ করেছে বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও প্রায় সকল কুশীলবদের অভিনয়।
কেন্দ্রীয় দুটি চরিত্র চিত্রাঙ্গদা ও অজুর্নের চরিত্রে ছিলো যথাক্রমে মার্জিয়া স্মৃতি (কুরূপা) ও অন্তরা সাহা। চিত্রাঙ্গদা (সুরূপা)’র চরিত্রে ছিলো ইশানী চৌধুরী।
তাদের সঙ্গে সখী, শিকারী দলেরসদস্য হিসাবে যারা কাজ করেছে তারা সবাই অপেশাদার। অনেকের জন্ম ও বেড়ে উঠা এই প্রবাসে। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রী সবাই। এই অপেশাদার শিল্পীদের দ্বারা চিত্রাঙ্গদার সফল মঞ্চায়ন অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন প্রবাসীরা।
নৃত্যনাট্যে চিত্রাঙ্গদার (কুরূপা) চরিত্রে মারজিয়া স্মৃতির অভিনয় ছিলো অনবদ্য। দেহ ভঙ্গিমা, বচনে, চরিত্র সৃজন সহ সব কিছুতে তার পরিণত অভিনয় মুগ্ধ করেছে হল ভর্তি দর্শকদের। এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে এক নতুন স্মৃতিকে খুঁজে পেয়েছেন দর্শকরা।
চিত্রাঙ্গদা নৃত্য নাট্যটি পরিচালনায় ছিলেন গুনী শিল্পী, বাফার নৃত্যগুরু অনুপ কুমার দাস। একদল অপেশাদার শিল্পী নিয়ে এমন একটি সফল নাটক উপহার দেয়া সম্ভবত তার পক্ষেই সম্ভব। তিনি তার টীমকে দিয়ে অসাধারণ দেহ ভাষা ও বাচিক অভিনয়ের দ্বারা নৃত্য নাট্যটি দৃশ্যায়ন করেছেন। সর্বোপরি নৃত্য নাট্যটির পোষাক, সঙ্গীত, সেট, আলো, কোরিওগ্রাফী সব মিলিয়ে তার পরিচালনায় একটি অসাধারণ নাট্য ক্রিয়া সংগঠিত হয়েছে নিউইয়র্কের নাট্য মঞ্চে যা দর্শকরা দীর্ঘদিন মনে রাখবে। বাফার এই পরিবেশনা নিউইয়র্কে বাংলা সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে নৃত্যে অংশ গ্রহণ করে অপ্সরা দত্ত, অঙ্কিতা পাল, অমৃতা সাহা, আদৃতা মন্ডল, জাসিয়া নূর, অদিতি ভৌমিক, জারা কাদির, মাহজাবিন ইশরাত, তুলসী রানী দেব, নোরা আকতার, নাসিমা চৌধুরী, আবৃতি, সনচিতা ঘোষ, সারাফ ওয়াসিমা রহমান, প্রমিতা সাহা, চৈতন্য, কথা, মায়া, রিয়া, নির্জা ও দিবা।
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে অংশ নেয় মার্জিয়া স্মৃতি (চিত্রাঙ্গদা কুরূপা) ইশানী চৌধুরী (সুরূপা) অন্তরা সাহা (অর্জুন) আনিকা সাহা (মদন)। গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করে ফাতিহা, অর্পিতা, জারা, দিবা, তিশা। হরিণের চরিত্রে অভিনয় করে কথা, মায়া, রিয়া এবং চৈতন্য এবং বাঘের চরিত্রে নির্জা।
হান্টার এবং সখি চরিত্রে রূপায়ন করেন সনজিদা ইসলাম অর্পি, নুজহাত ফাইজা, মৃদুলা আলম, নির্মা গোলদার, কৃষ্ণদেব, মিলান দেব, আনিকা কোসার এবং ইসা রায়।