নিউইয়র্ক হারালো যে সদাস্মার্ট যুবককে
সালেম সুলেরী,নিউইয়র্ক: প্রিয় শহর নিউইয়র্ক থেকে অনেকদিন দূরে। কিন্তু ফিরলেও সেই হাসিমুখটি আর মিলবেনা। সে ছিলো কমিউনিটির অত্যন্ত পরিচিতজন। কারো সাথে তেমন বিরোধ দেখিনি। একদা সাংবাদিকতায় নিবেদিত ছিলো। কিন্তু কমিউনিটির বাংলা মিডিয়া ততোটা স্বনির্ভর নয়। এ জন্যে মুঠোভরা সম্মানী দিতে পারে না। অধিকাংশেরই ‘আয় দিয়ে দায়’ মেটানোর অবস্থা। ফলে, এই প্রিয়মুখটি ট্যাক্সি-তে মনোযোগ দিয়েছিলো। বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদও ট্যাক্সি চালাতো। তসলিমা নাসরিনের এক পর্বের স্বামী। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু, এখন প্রয়াত। নিউইয়র্কে পুনঃসাক্ষাতের পর একটি প্রশ্ন করেছিলাম। কাজ-কর্ম কোথায়, কেমন চলছে। উত্তর করেছিলো সড়ক পরিবহন সেক্টরে। মিনারের মতোই পিছুটানহীন জীবন ছিলো বন্ধুটির। প্রবাসে পোশাকী নাম গোলাম মল্লিক। বাংলাদেশ থেকেই জানা-শোনা। আমরা চিনতাম ‘গোলাম হোসেন বেচু’ নামে। চলচ্চিত্র বিষয়ক সাংবাদিকতা করেছে দীর্ঘদিন। পৈতৃকবাস মধু-মৎস্যখ্যাত বৃহত্তর খুলনায়। মফস্বল সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনের শুরু। হঠাৎ আলোচনায় এলো এক চিত্র নায়িকাকে বিয়ে করে। ‘নীপা মোনালিসা’র প্রথম স্বামী মল্লিক। বিয়েটা অবশ্য টেকানো যায়নি। পরে ঘরনী করেছে একজন বিমানকন্যাকে। প্রবাসিত সে ঘরে সন্তান-সুখও মিলেছিলো। তারপরও বোহেমিয়ান ছিলো জীবন-যাপন। নিউইয়র্কে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হতো। ফেসবুক পোস্টে নানামুখী নারীদের সঙ্গ। মূলধারার বিনোদন জগতই যেন তার আরাধ্য। ২০০৮-এর এক পরিস্কার দুপুর। আমি তখন সাউথ জ্যামাইকার ন্যাডাল প্লেসে। দু’জন বিখ্যাত বন্ধুকে নিয়ে মল্লিক হাজির। সাংবাদিক মাহমুদ তাসের ও নাজমুল আহসান। প্রথমজন তখন ইত্তেফাক-এর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি। দ্বিতীয়জন ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। আমার অফিস কাম বাড়িটি হৈ হৈ করে উঠলো। মল্লিক বললো- আজ শুধুই আড্ডা। সোমরসে-সিক্ত দুপুরটা কাটাবো স্মৃতিচারণ দিয়ে। আজ চার মহারথির প্রথম জীবনের গল্প। একজন করে বক্তা, তিনজন শ্রোতা। সময়সীমা এক গ্লাস জলের চুমুকসীমা। এক রাউন্ড গ্লাস-জল শেষ, বক্তব্য শেষ। এরপর আরেককজন, এভাবে চলবে। সালেম সুলেরী মল্লিক একদা কবিতাও লিখেছে। আড্ডাসূত্রে বেরিয়ে এলো তথ্যটি। নাজমুল আহসান বললেন, দু-একটি কবিতা শুনি। মল্লিক জানালো স্মৃতিতে কিছুই নেই। প্রেমের দেবীরা হাওয়া, কবিতাও হাওয়া হাওয়া। তবে মাহমুদ তাসেরও কবিতা লিখতো। এখন ‘অলমোস্ট রিটায়ার্ড’ অবসরপ্রাপ্ত। সেই অংকে সুলেরী আমাদের কবিতামন্ত্রী। যা চালাচ্ছে সবি চলছে। রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, ওয়াও…। ঐ দিন মল্লিক খুলনা-জীবনকে খুলে দিয়েছিলো। মাহমুদ তাসেরের পৈতৃকবাস বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন খুলনাতেই। ফলে দু’জনের গল্প যেন অনেকটা এক। তারপরও গোলাম মল্লিক পুরোদস্তুর খুলনার পোলা। নানা বিবরণে এঁকে গেলো নানাচিত্র। আমরা বললাম, স্থানীয়রা খুলনাকে ‘খুলনে’ বলে। মল্লিকের রসসিক্ত সংলাপেও সেটি প্রকাশ পেলো। সেদিন থেকে আমরা মল্লিককে ‘খুলনে’ নামে ডাকি। দেখা হলেই হ্যালো মি. খুলনে! না, এতে তেমন অভিযোগ করতো না। তবে অনুযোগের সুরে বলতো, প্লিজ আর না। আমরাও যেন নাছোড় বান্দা। বলতাম, তাহলে আসল নামেই ডাকি ‘বেচু’। সেটাইতো বাবা-মা আর এলাকাবাসীর প্রিয়। প্রতিউত্তরে বলতো সর্বনাশ। এটাতো প্রবাসীদের প্রিয় নাম নয়। কেনো ‘মল্লিক’ নামে ডাকতে কি গলায় কাঁটা বাঁধে। সকল বাঁধা ছিন্ন করে চলে গেলো বন্ধুটি। পৃথিবীতে দোষে-গুণেই মানুষ। আমি সকলের গুণপনাকে আগে বিবেচনা করি। মল্লিককে শুরু থেকেই আমার ভীষণ পছন্দ। আশির দশকে ঢাকায় পরিচয়পর্ব থেকেই। স্ত্রী নীপা মোনালিসাকে হারানোর পর কী বিপর্যস্ত! আকস্মিকভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো। এরপর জীবনের চর ঠেলে স্রোত এনেছিলো। আটলান্টিকের পাড়ে নিউইয়র্কে কতো ঝড়। কতো উথাল-পাতাল ঢেউ-এর মুখোমুখি। কিন্তু সমাজে পরাজিত হতে চায়নি। আজীবন একটি স্বর্ণ-বৈশিষ্ট বজায় রেখেছিলো। আর তা হলো ‘অল টাইম স্মার্টনেস’। নিজেকে চমৎকারভাবে উপস্থাপনের প্রোজ্জ্বল ক্ষমতা। জীবনে অনেক বিত্তশালী, প্রতিভাধর দেখেছি। এমন স্বাগতিক বা স্মার্ট মানুষ তেমন দেখিনি। গোলাম মল্লিকের তিরোধানÑ এক সুবিশাল অভিশাপ। বিশেষত আমরা যারা বন্ধু-নির্ভর প্রবাস পরিজন। বুকে জড়িয়ে ধরার মানুষগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে। খ্রিস্ট্রীয় বর্ষের সূচনা মাস জানুয়ারী। এ মাসেই খরচের খাতায় গেলো মল্লিক। রূপসা নদী-ছোঁয়া সাঁতার-শৈশব। আটলান্টিক মহাসাগরের উপকণ্ঠে বিলীন। মাঝখানে ৬০ বছরের উদ্দ্যম আয়ু। মল্লিকবিহীনতায় এখন আচার-অনুষ্ঠানাদি। নিউইয়র্কের বাঙালী ঘরানা যেন অনেকটাই ম্লান। বিদেহী আত্মার স্বর্গীয় সুখ কামনা। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে রাখি বিনীত অনুরোধ। স্বর্গেও যেন সে চিরস্মার্টই থাকতে পারে। সেই সক্ষমতার পক্ষে আমাদের ইহলৌকিক আবেদন।