নিউইয়র্কে বাংলা সংস্কৃতির প্রিয়মুখ মনিকা রায়

166

এসএম সোলায়মান,নিউইয়র্কঃপ্রায় ২ যুগ ধরে প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে জাগ্রত রাখার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মনিকা রায়।৯০ দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভূক্ত কন্ঠশিল্পী। যুক্তরাষ্ট্রে এসেও ধারন করে রেখেছেন সংস্কৃতির ধারা। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পকলা একাডেমী ইউএসএ ইনক, ম্যানহাটন ও কুইন্স বাংলা স্কুল। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কন্স্যুলেটের মাধ্যমে দেশ থেকে বই এনে নিয়মিত পরিচালনা করছেন ছোটদের বাংলা স্কুল। বাইরের সহযোগিতা ছাড়াই নিজ প্রচেষ্টায় চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা। received_259649238026227অপরদিকে নিউইয়র্কের দেশ ও প্রবাসের গীতিকার শিল্পী ও সংস্কৃতিমনাদের নিয়ে ২০১২ সালে কুইন্সে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পকলা একাডেমী ।যার মাধ্যমে নিয়মিত শিল্পীদের পাশাপাশি এদেশে জন্ম নেয়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভুদ ছোট্ট শিশুদের নিয়মিত শিখাচ্ছেন আবহ বাংলার নাচ, গান ও আবৃত্তি। বিদেশী ভাষায় বেড়ে উঠা এসব শিশুদের কন্ঠে দেশের গান যেকোন অনুষ্ঠানে আলোড়িত করে দর্শকদের। একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষার গান থেকে বৈশাখী গান। ভাওয়াইয়া থেকে মারফতি, ফোক থেকে আধুনিক। সকল গানেরই পারদর্শী হয়ে উঠেছে খুদে শিল্পীরা। নিউইয়র্কের যেকোন বড় বাংলা সাংস্কৃতির আসরে চমৎকার পরিবেশনা মনে করিয়ে দেয়, ফেলে আসা প্রিয় মাতৃভূমিকে। নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশন(এনএবিসি) ২০১৫’র কালচারাল চেয়ারম্যান ছিলেন মনিকা রায়। তার নেতৃত্বেই উত্তর আমেরিকার অন্যতম সর্ববৃহৎ এনএবিসি আসরের উদ্বোধনীতে নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংগীত শিক্ষালয়ের ছোট বড় ৩ শতাধিক শিল্পীর পরিবেশনা ছিলো স্মরণীয়। ম্যানহাটনের হোটেল পেনসিলভেনিয়াতে অনুষ্ঠিত ৩ দিনের ওই কনভেনশনে সেরা পারফর্মেন্সের জন্য বেশ সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। প্রবাসের সর্ববৃহৎ কমিউনিটি সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির দুইবারের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনিকা রায়ের প্রতিষ্ঠিত শিল্পকলা একাডেমি ইউএসএ ইনক ও ম্যানহাটন বাংলা ও সাংস্কৃতিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশন ও কন্স্যুলেট অফিসে রাষ্ট্রীয় সকল দিবসেই নিয়মিত পরিবেশনা করছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । প্রবাসে বাংলা ভাষা সাংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ মিশন, কন্স্যুলেটসহ অনেক আঞ্চলিক সংগঠন থেকে বহু সম্মাননা পেয়েছেন সংগীত কন্যা মনিকা রায়। আর আমেরিকার মূলধারার সার্টিফিকেট, প্রক্লোমেশন ও সম্মাননা নিয়মিত পেয়েই যাচ্ছেন তিনি। নিউইয়র্কের গভর্নর, মেয়র, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, এসেম্বলীম্যান কাউন্সিলম্যান সবার হাত থেকেই গ্রহন করেছেন সম্মাননা সনদ। নিউইয়র্কে মনিকা রায় প্রতিষ্ঠিত বাংলা ও সাংস্কৃতিক স্কুলের কার্যক্রম দেখে অভিভূত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও কন্সাল জেনারেল।প্রতিষ্ঠাতা মনিকা রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় শিল্পকলা একাডেমী ইউএসএ ইনক’র কায্যালয়ে প্রতি শনি ও রবিবার চলে শিশুদের গানের ক্লাস। প্রবাসের খ্যাতনামা বাংলা গানের শিক্ষক সমীরণ বড়ুয়া নিয়মিত ক্লাশ নিচ্ছেন। বাস্তবতাকে নিয়েই দেশের গান বাধেঁন তারা। একুশে প্রদক প্রাপ্ত স্বাধীন বেতারের গানের নায়ক মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়, একুশে প্রদক প্রাপ্ত ডঃ অরুপ রতন চৌধুরী, দেশ বরেন্য সাংবাদিক,গীতিকার ও সুরকার জীবন চৌধুরী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীতজ্ঞ নাদিম আহমদ, দেশ বরেন্য নাট্যকার জামাল উদ্দিন, চলচিত্রকার কবির আনোয়ার, খ্যাতিমান নাট্য তারকা লুৎফুর নাহার লতা, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি নার্গিস আহমেদ, নটরডেম কলেজের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপিকা হোসনে আরা বেগম, কবি, লেখক ও সাংবাদিক এবিএম সালেহ উদ্দিনের মত বহু গুণীজন রয়েছেন শিল্পকলা একাডেমী ইউএসএ ইনক’র উপদেষ্টা পরিষদে।
শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে দেশ ও প্রবাসে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ডঃ অরুপ রতন চৌধুরী, ডঃ নুরন নবী, গীতিকার জীবন চৌধুরী, সাংবাদিক রাশেদ আহমেদ, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রতন বড়ুয়া, সরাব সরকারসহ অনেক গুণীজন ও মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা দিয়েছেন।
বাংলা গানের তারকাদের নিয়ে একক সংগীত সন্ধ্যা করেছেন মনিকা রায়। বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশনের খ্যাতিমান শিল্পী শাহিন খান, এটিএন তারকা রেজোয়ানুল হক, এনটিভি তারকা খায়রুল ইসলাম সবুজ,কলকাতার সংগীত গুরু শান্তনু ভৌমিকসহ দেশ ও প্রবাসের বহু কন্ঠ শিল্পীদের সম্মানে আয়োজন একক গানের অনুষ্ঠান।
সংবর্ধনা দিয়েছেন বাংলা গানের কিংবদন্তী মোস্তফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমানকে।
অর্থাৎ প্রবাসে এসেও বাংলাদেশ ও বাংলা সাংস্কৃতিকে সম্মান দিয়ে যাচ্ছেন মনিকা রায়।
সংগীত কন্যা মনিকা রায়ের জন্ম ও বেড়ে উঠা চট্রগ্রামের দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপের সারিকাইত গ্রামের রায় চৌধুরী বাড়িতে। বাবা প্রয়াত জ্যোর্তিলাল রায় চৌধুরী ছিলেন সন্দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী মাইটভাংগা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা দীপালী রায় চৌধুরী ছিলেন একজন গৃহিনী। ৮ ভাই বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ মনিকা রায়। হাইস্কুল শেষ করে গানের হাতে খড়ি হয় ঢাকায়। মনিকা রায়ের বড় ভাই ঊষাকান্ত রায় চৌধুরী কলকাতা কালিগঞ্জের ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, মেঝভাই প্রশান্ত রায় চৌধুরী লন্ডন ইলফোর্ডের চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। পিকে চৌধুরী চ্যাটার্ড একাউন্টিং নামে তার একটি ফার্ম রয়েছে। তিনি ছিল্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র।
সেজো ভাই সুশান্ত রায় চৌধুরী নিউইয়র্কের ব্রুকলীনে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি লন্ডন থেকে চ্যাটার্ড একাউন্টিং লেখাপড়া করে নিউইয়র্কে এসে ব্যবসা করছেন। নিউইয়র্কে মনিকা রায়ের একমাত্র অভিভাবক সেজো ভাই সুশান্ত রায় চৌধুরীর মাধ্যমেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ও ইমিগ্র্যান্ট হন। ছোট ভাই সুমন রায় চৌধুরী কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আর ছোট বোন মালা রায় চৌধুরী ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
দুই সন্তানের জননী মনিকা রায়ের প্রয়াত স্বামী মতিলাল দাশ ছিলেন ঢাকায় খামার বাড়ী কৃষি ইন্সটিটিউটের একজন সরকারি কর্মকর্তা।
বড় ছেলে লিমেন দাশ বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তা আর ছোট ছেলে রুমেন দাশ ঢাকায় ব্যবসা করছেন।
প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতিকে যেমন লালন করে চলছেন তেমনি একজন মা হিসেবেও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
মনিকা রায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ঢাকায় একটি বিদেশী ফ্যাশন হাউজে সুপারভাইজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় আয়োজন সংগীতা, বাঁশরী ও উজ্জীবন অনুষ্ঠানে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন। ১৯৯৮ সালে লন্ডন যান তিনি। সেখান থেকে সেঝো ভাই সুশান্ত রায়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কে আসেন। ১৯৯৮ সাল থেকেই তিনি নিউইয়র্কে ভাই/ভাবীর সাথে স্থায়ীভভাবে বসবাস শুরু করেন।
জীবন সংগ্রামী মনিকা রায় ২০১১ পর্যন্ত আমেরিকার কর্পোরেট স্টোর গুলোতে ইউনিয়ন জব করতেন।
পাশাপাশি শিল্প ও সাহিত্য চর্চায় নিয়মিত কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে নিউইয়র্কে লোকজ সম্মেলনে কন্ঠ শিল্পী মনিকা রায়ের প্রথম একক সংগীত অনুষ্ঠিত হয়েছে।নিউইয়র্কে উত্তরণ শিল্পী গোষ্ঠী, সুরবিতান, সংগীত পরিষদ, সদারংসহ বিভিন্ন শিল্পী সাহিত্য পরিষদের সাথে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। স্বরচিত কবিতা ও গানের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিকএখন সময় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। মনিকা রায়ের গানের একটি সিডি প্রকাশের অপেক্ষা।
প্রায় দুই যুগ ধরে প্রবাসে বাংলা সাংস্কৃতির সেবক মনিকা রায় ২০০৮ সালে সাহিত্য সম্পাদক পদে বাংলাদেশ সোসাইটিতে প্রথমবার নির্বাচন করেন। এরপর সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। টানা দুইবারই তিনি বাংলাদেশ সোসাইটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। এবারও তিনি সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নিউ আমেরিকান ভোটার এসোসিয়েশন নাভা’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিকা রায় প্রবাসে বাংলা সাংস্কৃতির লালনে সবসময়ই কাজ করে যেতে চান।
মনিকা রায় বলেন, আমি বাংলাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি বাংলা সাংস্কৃতিকে। কমিউনিটির সেবায় ২০ বছর ধরে কাজ করছি। নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ সব সময়ই আমার কাজে সহযোগিতা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। অভিভাবকের মত আমাকে গাইড করেছেন। তাই কমিউনিটির জন্য কাজ করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, টাকা থাকলে মেয়েরা স্বর্ণালংকার,দামী ফার্নিচার কিনে অথবা সঞ্চয় করে। আমি টাকা হলে একটা ঢোল তবলা হারমোনিয়াম আর বই কিনি। আমার একশ’ ডলার সঞ্চয়ও নেই। আমার সঞ্চয় প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি। কমিউনিটির শিশু কিশোরদের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতি
টিকিয়ে রাখার কাজ করাই আমার জীবনের ব্রত।
মনিকা রায় বলেন, বাংলা সাংস্কৃতি আমার রক্তে। তাই এটা নিয়েই থাকতে চাই। আমি এবারও বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনে নয়ন-আলী প্যানেল থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছি। এর চেয়ে বড় পদে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। আমি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। তাই এই পদেই থাকতে চাই। তিনি বলেন, জয়-পরাজয় যাই হোক বাংলা সংস্কৃতির জন্যই কাজ করে যাবো।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.