পরিচয় গোপন করে বিদেশ ভ্রমণে রাসিক কাউন্সিলররা
বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো নিয়মই মানছেন না রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা। বিদেশ ভ্রমণের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন (জিও) নেওয়া বাধ্যতামূলক; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এই পরিপত্র ভেঙে তারা বিদেশ ভ্রমণে মেতেছেন। পরিচয় গোপন করে তারা ছুটছেন বিদেশে। বিদেশ যাতায়াত করছেন ইচ্ছেমতো। তবে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অনুমতি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের কোনো সুযোগ নেই। এ রকম প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, সৌদি আরব ভ্রমণ করে গত সপ্তাহের শেষ দিকে ফিরেছেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল মোমিন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনা ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পচা। এর আগে তারা ২২ মার্চ সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা দেন। সৌদি আরবে গিয়ে সেখানকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে দাঁড়িয়ে তারা একসঙ্গে বহু ছবি তুলেছেন এবং ফেসবুকে তা শেয়ার করেছেন। কাউন্সিলরদের ব্যক্তিগত ফেসবুক থেকেই নিশ্চিত হওয়া গেছে, তারা সৌদি আরব ভ্রমণ করেছেন। তাদের অনুসারীরাও সগৌরবে তা ফেসবুকে ছড়িয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বিদেশ ভ্রমণে এই তিনজন কাউন্সিলরের মধ্যে কারোরই সরকারি অনুমোদন (জিও) ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে গোপনে তারা বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশ থেকে আবার ফিরেও এসেছেন; কিন্তু তাদের বিদেশ ভ্রমণের কোনো তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। এমনকি এই তিন কাউন্সিলরের ছুটির বিষয়ে দাপ্তরিকভাবেও কিছু জানেন না সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সচিব মশিউর রহমান বলেন, ‘তিন কাউন্সিলর ওমরাহ করতে (সৌদি আরব) গেছেন- এটি আমি জানি না।’
অথচ ২০১১ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবদুল করিম স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়েছে- ‘সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের বিদেশ ভ্রমণে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী অনুমোদন দেবেন।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই নির্দেশনাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা। তারা যে যার ইচ্ছেমতো বিদেশ ভ্রমণ করছেন। মন্ত্রণালয়কে অবহিতও করেন না। এমনকি তারা সিটি করপোরেশন থেকে যে ছুটির আবেদন করেন তাতেও অনেকেই বিদেশ ভ্রমণের কথা উল্লখ করেন না। তাদের ছুটি মঞ্জুর করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সচিব মশিউর রহমান স্বাক্ষরিত এ রকম ছুটি মঞ্জুরের একটি কপি এসেছে আমাদের সময়ের হাতে। এতে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের এক কাউন্সিলর ছুটির জন্য আবেদন করেছিলেন। তার আবেদনে সৌদি আরব ভ্রমণের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার ১৫ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছেন সচিব। সচিবের জারি করা ছুটি সংক্রান্ত অফিস আদেশেও বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি উল্লেখ নেই। ওই কাউন্সিলর ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেছিলেন।
সিটি করপোরেশনের একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই বিভিন্ন সময়ে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন সিটি করপোরেশনের ৪০ কাউন্সিলরের মধ্যে বেশির ভাগই। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রজব আলী, সংরক্ষিত আসন ৩-এর কাউন্সিলর মুসলিমা বেগম বেলী, সংরক্ষিত আসন ৫-এর কাউন্সিলর সামসুন নাহার, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহুল আমিন, ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবিউল ইসলাম তজু, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল মোমিন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনা ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পচা, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম সুমন, ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম উল আযীম, ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল হামিদ সরকার টেকন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরমান আলী। অনেক কাউন্সিলরই নিয়মিত ভারত ভ্রমণ করেন মন্ত্রণালয়ের জিও ছাড়া। তাদের মধ্যে কেউ যান চিকিৎসার জন্য। আবার কেউ যান সে দেশে পড়তে যাওয়া সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। অনেকেই আবার যান ভ্রমণে ও শপিং করতে। তারা সিটি করপোরেশন থেকে ছুটি নিয়েই চলে যান। এ ছাড়া ২০২২ সালের মে মাসে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনে নেপাল ভ্রমণে গিয়েছিলেন সিটি করেপারেশনের ২১ কাউন্সিলর। একটি প্রকল্পের আওতায় তারা নেপাল ভ্রমণ করেন। তখন কাউন্সিলরদের জিও ছিল না। তবে নেপাল ভ্রমণের বহরে থাকা ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘বিদেশ ভ্রমণে কাউন্সিলরদের জিও প্রয়োজন হয় না। তবে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হয়। আমরা অবহিত করেই নেপাল গিয়েছিলাম।’
সদ্য সৌদি আরব থেকে ফেরা ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জিওর প্রসঙ্গ শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘আপনার যা ইচ্ছে লিখে দেন। আমার কিছু বলার নেই।’
তবে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম উল আযীম বলেন, ‘মন্ত্রণালয় আমাদের পাত্তা দেয় না। আবেদন দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকে; কিন্তু অর্ডার মেলে না। দেখা যায় আবেদনের পর ভ্রমণের সময়ই পার হয়ে যায়। তার পরও জিও হয় না। এ কারণে ওই ঝামেলায় যেতে চান না কাউন্সিলররা।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই কাউন্সিলরদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘কাউন্সিলররা পরিচয় গোপন করে চলে যাচ্ছেন; কিন্তু এটি উচিত নয়। ইমিগ্রেশন জানতে পারলে আটকে দেবে। তবে তাদের অবশ্যই মন্ত্রণালয়ের জিও নিয়েই বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন অনুবিভাগের উপ-সচিব (সিটি করপোরেশন-২) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশ যেতে হলে কাউন্সিলরদের অবশ্যই জিও নিতে হবে। মন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে- এটি বাধ্যতামূলক। আর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর পরিচয় গোপন করে বিদেশ যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত বা সরকারি- যে কোনো কাজেই হোক না কেন, কাউন্সিলর পরিচয়েই যেতে হবে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’