প্রবাসের বাংলা সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব চাই, সুস্থ প্রতিযোগিতা চাই

485

নিউইয়র্ক (ইউএনএ): প্রবাসের জনপ্রিয় টেলিভিশন টাইম টিভির মিডিয়া বিষয়ক বিশেষ মুক্ত আলোচনায় নিউইয়র্কের শীর্ষ ৮ প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক বলেছেন, নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী কমিউনিটি বিনির্মাণে প্রবাসের বাংলা মিডিয়াগুলো গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। কোন অবস্থাতেই মিডিয়ার ভূমিকাকে ছোট বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে প্রবাসের বাংলা মিডিয়াগুলো নিজেদের অবস্থান যেমন সুসংহত করেছেন, তেমনী ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী কমিউনিটি বিনির্মাণে অব্যাহত ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু অপ্রিয় আর দু:খজনক হলেও সত্য যে, কতিপয় মিডিয়া অপেদারিত্ব এবং ঢাকার কোন কোন মিডিয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রবাসমুখী উদ্যোগ স্থানীয় বাংলা মিডিয়াগুলোকে হুমকীর মুখোমুখী করে তোলছে। editors-1-900x450সম্পাদকগণ বলেন, স্থায়ীয় বিজ্ঞাপনের বাজার বা মার্কেট যাচাই-বাছাই না করেই অনেকেই নিউইয়র্ক থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছেন বা প্রকাশ করছেন, যা আঘাতিরর সামিল। সম্পাদকগণ বলেন, আমরা প্রবাসের বাংলা সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব চাই, সুস্থ প্রতিযোগিতা চাই, সেবাদানের পাশাপাশি সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে চাই।
২০ ফেব্রুয়ারী বিকেল ৫টায় টাইম টেলিভিশনের নিজস্ব স্টুডিওতে সম্পাদক ‘প্রবাসে সংবাদপত্রের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। প্রায় দেড় ঘন্টা স্থায়ী ‘লাইভ’ এই আলোচনার হোস্ট ছিলেন সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক ও টাইম টেলিভিশন-এর সিইও আবু তাহের। আলোচনায় অংশ নেন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, সাপ্তাহিক ঠিকানার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন, সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, সাপ্তাহিক আজকাল-এর প্রধান সম্পাদক জাকারিয়া মাসুদ জিকো, সাপ্তাহিক দেশবাংলা ও বাংলা টাইমস সম্পাদক চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান, সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার, সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ। খবর ইউএনএ’র।
অনুষ্ঠানে আলোচক সম্পাদকগণ তাদের আলোচনার শুরুতেই ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। এর আগে সঞ্চালক আবু তাহের ‘প্রবাসে সংবাদপত্রের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ’ মুক্ত আলোচানা অনুষ্ঠানের কারণ তুলে ধরেন।
আলোচনার শুরুতেই সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান বলেন, নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা মিডিয়ার বাজার যাচাই-বাছাই না করেই ঢাকার কোন কোন করপোরেট হাউজ প্রবাস থেকে মিডিয়া প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ায় কমিউনিটিতে বিশেষ করে ব্যবসায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা ও মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে নিউইয়র্কের শীর্ষ ১০ বাংলা মিডিয়ার সম্পাদকরা উদ্বিগ্ন।editors-3
এরপর সাপ্তাহিক ঠিকানার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন বলেন, বিগত ৩০ বছর ধরে আমরা নিউইয়র্ক থেকে বাংলা মিডিয়া প্রকাশ করে কমিউনিটি সাংবাদিকতায় স্থায়ী আসন গেড়েছি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে কারো কারো অপেশাদারিত্বের কারণে প্রবাসের সাংবাদিকতা আর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তিনি বলেন, কোন কোন ব্যবসায়ীকে বিজ্ঞাপনের জন্য কোন কোন মিডিয়ার সম্পাদক বিজ্ঞাপনের জন্য হুমকী দিচ্ছেন, চাপ সৃষ্টি করছেন, যা অত্যন্ত দু:খজনক এবং লজ্জার বিষয়। আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে কমিউনিটির সচেতন মহল প্রবাসের বাংলা মিডিয়াগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করার নতুন পথ ফিরে পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান বলেন, আমরা প্রবাসে বাংলা ভাষায় আমেরিকান মিডিয়া প্রকাশ করি। আমরা অশুভ প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানাই। আমরা যারা বিগত ২০/৩০ বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমেরিকান প্রডাক্ট ‘বাংলা মিডিয়া’ তৈরী করেছি, সেখানে ঢাকা থেকে পূঁজি নিয়ে এসে প্রবাসের মিডিয়াগুলোকে অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করা কাম্য নয়। তিনিন প্রশ্ন রেখে বলেন, ঢাকার পূঁজির উৎস বা মিডিয়া প্রকাশের কারণ কি? তাদের উদ্দেশ্য কি? কমিউনিটি তা জানতে চায়।
সাপ্তাহিক আজকাল-এর প্রধান সম্পাদক জাকারিয়া মাসুদ জিকো বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে প্রবাসের শীর্ষ ১০ সম্পাদকের প্রথম সভা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কিভাবে এই মিডিয়া শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। নিউইয়র্কের মিডিয়াগেুলো যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাতে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নানা সমস্যার মুখোমুখি হবে। তিনি বলেন,  হঠাৎ করে ঢাকা থেকে কয়েকটি পত্রিকা নিউইয়র্কে এসে ‘আন হেলথদী’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে, সুস্থ্য নয়। এব্যাপারে আমরা প্রবাসীদের সহযোগিতা চাই। তিনি বলেন, আমরা প্রবাসীদের পাশে ছিলাম, আছি এবং আগামী দিনেও পাশে থাকবো।
সাপ্তাহিক দেশবাংলা ও বাংলা টাইমস সম্পাদক চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান বলেন, মিডিয়া ছাড়া কেউ জানতে পারতেন না যে প্রবাসে কোন কোন বাবসা আছে। কমিউনিটির জ্য এই সেবা দিচ্ছে প্রবাসের বাংলা মিডিয়াগুলো। তিনি ঢাকার মিডিয়া নয়, প্রবাসের মিডিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের জন্য কমিউনিটির প্রতি আহ্বান জানান।
সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার বলেন, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে প্রবাসের ১০/১৫টি পত্রিকা থাকার পরেও ঢাকা থেকে আরো পত্রিকা আসতে হবে কেন? ভারতীয় ও পাকিস্তানী কমিউনিটির পত্রিকা ৪/৫টি হলে আমাদের ১৬টি পত্রিকা থাকতে হবে কেন? তিনি বলেন, টাইম টেলিভিশন আর টিবিএন২৪ সহ ঢাকার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো প্রবাসে বাংলাদেশী কমিউনিটির চাহিদা পূরণ করছে। এখানে যখন নতুন টিভি বা প্রিন্ট মিডিয়ার দরকার নেই, সেখানে ঢাকা থেকে এসে প্রিন্ট মিডিয়া প্রকাশ করতে হবে কেন? আর তাদের পূঁজিই বা কোত্থেকে আসছে? বাংলাদেশ সরকার কি তাদের পুঁজির উৎস সম্পর্কে জানে?, তারা কি ট্যাক্স দিচ্ছেন? তিনি বলেন, প্রবাসের মিডিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কমিউনিটির।
সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, ঢাকা নয়, প্রবাসীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিউইয়র্কের বাংলা মিডিয়াগুলো টিকে রয়েছে। আমরা অশোভন কিছু চাই না। আমরা অশুভ প্রতিযোগিতাকে হেইট করি। তিনি বিবেচনা মাথায় রেখে প্রবাসের মিডিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য কমিউনিটির বিজ্ঞাপনদাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি অনুরোধ জানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ দূতাবাস, মিশন ও কনস্যুলেটের প্রতি সুদৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে প্রবাসের মিডিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা করা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক আবু তাহেরের ‘কমিউনিটির কাছে প্রত্যাশা’ প্রশ্নে এম এম শাহীন বলেন, ঠিকানা প্রকাশ করতে গিয়ে আমার চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাঠে উঠেছে, আমি নি:স্ব হয়েছি। অনেক দু:খ-কষ্ট পেরিয়ে ঠিকানা প্রকাশ করছি, সেবা দিচ্ছি। তারপরও হাল ছাড়িনি। কমিউনিটির স্বার্থে, ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটি গড়তে ঠিকানার প্রকাশনা অব্যহত রেখেছি। কিন্তু নতুন নতুন কিছু সম্পাদক আমাদেরকে হুমকীর সম্মুখীন ফেলে দিচ্ছেন। তিনি প্রবাসে সাংবাদিকতা পেশার সম্মান বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ সম্মত’ পেশা আর  পেশাদারিত্বে দারিত্ব বজায় রাখুন। তিনি বলেন, আমরা কমিউনিটির মানুষকে বড়লোক করে মিডিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, বড়লোক হতে নয়।
ডা. ওয়াজেদ এ খান বলেন, দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ১৬ লাখ পাঠক সৃষ্টি হয়নি। ঢাকার মিডিয়াগুলো নিউইয়র্ক নয়, দেশের মানুষদের জন্য ফ্রি পত্রিকা সরবরাহ করে দেশের মানুষদের সেবা করতে পারেন। তাদের নিউইয়র্ক আসতে হবে কেন?
জাকারিয়া মাসুদ জিকো বলেন, আমরা কমিউনিটিতে সাংবাদিকতা পেশার মান সমুন্নত রেখে কমিউনিটিকে আরো শক্তিশালী করতে চাই। মিডিয়ার বদৌলতেই বিজ্ঞাপনদাতাদের ব্যবসা ভালো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ডা. চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান বলেন, প্রবাসের মিডিয়ায় দুই শতাধিক মানুষের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রবাসের মিডিয়াগুলোতে বাঁচিয়ে রেখে তাদের পেশাদিরত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
রতন তালুকদার বলেন, মিডিয়ার সুস্থ প্রকাশনার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। ঢাকার মিডিয়াগুলো দেশের গ্রামের স্কুলগুলোতে তাদের পত্রিকা ফ্রি দিতে পারেন। তিনি বলেন, প্রবাসের মিডিয়াগুলোই বাংলাদেশী কমিউনিটি তৈরী করেছে। কমিউনিটির সাথে মিডিয়ার সম্পর্ক পানি আর মাছের সম্পর্কের মতো।
মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, পাঠক-পৃষ্ঠপোষকদের চাহিদা মোতাবেক মিডিয়াগুলোকেও সমন্বয় সাধন করে এগিয়ে যেতে হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.