প্রিয় বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা ইস্যু
আবুবকর হানিপ,ওয়াশিংটনডিসি:মিয়ানমারের নোবেল জয়ী অংসান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকার সম্প্রতি চমক লাগানো বক্তব্য দিয়েছে। জানিয়েছে, তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ মিশনকে ভিসা দেবে না।অথচ দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধেই জাতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের নির্মূলের মতো মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ বিরাজমান। যার মধ্যে গণহত্যা এবং গণধর্ষণের মতো ঘটনাও রয়েছে। এরপরও নোবেল জয়ী সু চির নীরব অবস্থান যেন আমাদের প্রদীপের নিচে অন্ধকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লাখের মতো রোহিঙ্গা মুসলমান বসবাস করে। তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে, দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না। তাদের মতে, রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশি অভিবাসী। আবার বাংলাদেশে ঐতিহাসিক কারণেই তাদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বর্তমানে প্রায় বন্দীজীবন কাটাচ্ছে। তারা ঠিকমতো চলাফেরা এবং জীবিকা নির্বাহও করতে পারছে না। কারণ তাদের কাছে পরিচয়পত্র নেই। এ কারণে দিনে দিনে সেখানে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। উখিয়া টেকনাফের ঘুমধুম, তমব্রু, বালুখালী, আঞ্জুমানপাড়া, রহমতের বিল, ধামনখালী, লাম্বারবিল এলাকা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। এদিকে অস্বাভাবিকভাবে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসছে। তাদের আশ্রয় দেওয়া উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য। তার ওপর সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্য, পানি ও ঔষুধের হাহাকার।
রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার শতভাবে লঙ্ঘিত হলেও শান্তিতে নোবেল জয়ী মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা অংসান সুচি একদম চুপ। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একদা বছরের পর বছর অন্তরীণ থাকার যন্ত্রণা সয়েছিলেন নির্বিবাদে। তেমনি যেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাশূন্য রাষ্ট্র করার ব্রত পালন করছেন এখন। রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়েছিল মূলত জিয়া সরকার শাসনামলে। ১৯৭৮ সালে জিয়ার সরকার জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়। দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তখন বার্মা থেকে পালিয়ে আসে। অনায়াসে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে আবারও আক্রমণ চালায়। ওই সময়ে নতুন করে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তাদের কোনো পরিকল্পিত ডাটাবেস না থাকায় পরবর্তীতে মাত্র এক থেকে দেড় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের স্বল্পসংখ্যক জাতিসংঘের নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে। বেশিরভাগই কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। ঠিক এভাবে ১৯৭৮ সালের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুটি কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়ার মতো একটি নতুন সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও এদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে ছিল না। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গার নিবন্ধন করা হয়েছিল।
শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার দায় বাংলাদেশের ওপর চাপানো অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক মুসলিম সম্প্রদায় নিশ্চুপ থাকা রীতিমতো অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন। চীন, রাশিয়া, পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ এবং ভারতের পরোক্ষ ইন্ধনে ইতিহাসের চরম নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা চলছে রাখাইন রাজ্যে। চীন সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভেটো দিয়েছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়ার পক্ষপাতী সে নয়। নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির প্রয়োজনে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে মুসলিম নামধারী পাকিস্তান। চীনের দৃষ্টি মিয়ানমারে প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাখাইন রাজ্যের ক্যাউকফিউর সমুদ্রবন্দরের প্রতি, এতে করে ভারত মহাসাগরে চীনের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করবে। রোহিঙ্গাদের অস্বীকারকরণ, স্কুলে পড়তে না দেওয়া, নিজের দেশের নাগরিক হয়েও অবাধ বিচরণ করতে না পারা মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের ফসল। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার, অসহায়ত্ব, অত্যাচার, বিতাড়ন এবং গ্রামের পর গ্রাম পোড়ানো অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঢুকার সুযোগ পাচ্ছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার সাহসী উদ্যোগ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়েছেন। বিষয়টি বিশ্বের প্রশংসার দাবিদার এবং তা বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে শুরু করছে।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের সৈনিকরা সিয়েরা লিওনে সাফল্যের সঙ্গে সমস্ত জাতিগোষ্ঠীকে একত্রিত করেছিল। তেমনিভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের ভিতর রোহিঙ্গাদের জন্য সেইফজোন গড়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে।
রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এ বিষয়ে একটি জনহিতকর প্রস্তাবনা পেশ করেন। ইতিবাচক, ভারসাম্যমূলক ও সপক্ষের গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবের পরপরই সাম্প্রতিক এ অত্যাচার, নিপীড়ন তুঙ্গে উঠে। এথনিক ক্লিনজিংয়ের নামে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠে মিয়ানমার সরকার। অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা এত ভয়াবহ যে তা আড়াল করার জন্য কোনো মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ত্রাণ সংস্থা, সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারছে না। মিয়ানমারে প্রচার করা হচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ঘর পুড়ে দিচ্ছে— যাতে তারা বাংলাদেশে আসতে পারে। বিবিসির প্রতিবেদক জনাথন হাইড যিনি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় মিয়ানমারে রাখাইন মুংডু অঞ্চলে গিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন দেন। এটি এখন সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। সেখানে রোহিঙ্গাদের ঘরে আগুন দিয়েছে এমন তিনজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাতে জানতে পেরেছেন তারা রাখাইনের জাতিগত বৌদ্ধ এবং পুলিশ তাদের আগুন দিতে বলেছিল।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান আমি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখি। এমনিতে নানা সমস্যায় জড়িত ১৬ কোটি জনসংখ্যার এক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। তাছাড়া বিগত চার দশক ধরে রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে সমস্যা ছড়াচ্ছে। আওয়ামী সরকার সব সময় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা করেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার সময়েও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থাপন করা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে থাকা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা। ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত আসা চার লাখ রোহিঙ্গাসহ সব রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম জেলা প্রশাসন শিগগিরই শুরু করবে। তাদের নাম ও ঠিকানার সঙ্গে ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হবে। বর্তমান সময়ে আমরা সব সময় তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছি। বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের এই উন্নয়ন অভিজ্ঞতা থেকে মিয়ানমার শিক্ষা নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে সম্ভাব্য সব কিছুই করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে শরণার্থী সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানে উপনীত হতে পারে। কেননা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষয়ে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশ প্রতিবেশী কোনো দেশের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কোনো সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে তার ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ দেবে না।
শুধুমাত্র মানবিকতা দেখিয়ে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। তা না হলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের জন্য সমূহ ক্ষতি করবে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী শক্তিগুলো। এই রোহিঙ্গা ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা অংশ। প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এই সমস্যাকে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে সক্ষম। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখতে পারে। এটাকে আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষ কূটনৈতিক কৌশল দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। নয়তো আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের বর্তমান স্থিতিশীল রাজনীতি নতুন ষড়যন্ত্র ও সহিংসতার দিকে যেতে পারে।
লেখক :প্রকৌশলী, শিক্ষক, প্রধান নির্বাহী :পিপলএনটেক