বর্ণাঢ্য আয়োজনে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে পহেলা বৈশাখ উদযাপন
এ্যন্থনী পিউস গমেজ, ওয়াশিংটন ডিসি: গত মঙ্গলবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬টায় ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে অত্যন্ত আরম্বরপূর্ন আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য “পহেলা বৈশাখ”। অনুষ্ঠানে মাননীয় রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মেদ জিয়াউদ্দিন, তার পত্নী মিসেস ইয়াসমীন জিয়াউদ্দিন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস পরিবারসহ ওয়াশিংটন প্রবাসী বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রচুর গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সমাজ কর্মী, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, লেখক-সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সিনেট এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রতিনিধিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দূতাবাসথেকে আগত বিশেষ অতিথিবৃন্দ এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহন করেন বিভিন্ন দূতাবাসের পক্ষে তাদের শিল্পীরা।
বাংলা নববর্ষের শুভারম্ভ বাংলাদেশ দূতাবাসের এমনি চমৎকার আয়োজনের মধ্য দিয়ে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে, বিশেষ করে দূতাবাস পরিবারের বর্ণাঢ্য এবং আন্তরিক আনন্দ আয়োজনে। সমস্ত আয়োজন জুড়ে ছিল বাংলা সংস্কৃতির প্রতিফলন, বৈশাখের প্রানের ছোঁয়া, স্বদেশ প্রেমের স্পর্শ এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সম্প্রীতির মিলন মেলা ! এই আয়োজনে আমেরিকান নাগরিকদেরসহ অন্যান্য দেশের কুটনীতিকদের আমন্ত্রন জানানোর আরেক বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং আমাদের নান্দনিক সাংস্কৃতিক চর্চা তাদের সামনে তুলে ধরা। উল্লেখ না করলেই নয় যে বিভিন্ন দূতাবাসের পক্ষে থেকে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানে একটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা, ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে এবারের আয়োজনে।
আয়োজিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের শিল্পীদের পরিবেশনায় পুরো অনুষ্ঠানটিতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রময় পরিবেশনায় একটি মূল সুর হৃদয়ের গভীরে গুঞ্জরিত হয়েছে- সংস্কৃতি তা সে যে দেশের, যে জাতীরই হোক না কেন, তার আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বজনীন সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়েই আমাদের মধ্য গড়ে উঠে এক সম্প্রীতির বন্ধন, আমরা অনুভব করি একাত্মতা এবং এর মধ্যেই বৃহতের আনন্দধারা বহমান। যেমন করে আমরা আবিষ্ট হয়েছিলাম বাংলাদেশের শিল্পীদের নান্দনিক পরিবেশনায়, তেমনি আপ্লুত হয়েছি অন্যান্য দেশের মাধুর্য্যমন্ডিত পরিবেশনায়- মনে হয়েছে দেশে দেশে বহমান সংস্কৃতির ভাষা মূলতঃ হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
অনুষ্ঠানটির শুরুতেই বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী, পলিটিক্যাল এন্ড কালচারাল- সামিয়া ইসরাত রণী দূতাবাস পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে অনুষ্ঠানে স্বাগতম জানান এবং বাংলাদেশে অন্যতম উৎসব- বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের উদযাপনের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য সবাইকে আহবান জানান। উল্লেখ্য, আয়োজিত পুরো অনুষ্ঠানটির প্রাঞ্জল সঞ্চালনায় ছিলেন মিসেস সামিয়া ইসরাত রণী এবং অত্যন্ত প্রানবন্ত উপস্থাপনায় পরিচালিত হয় সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে মাননীয় রাষ্ট্রদূত, জনাব মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন সবাইকে ধন্যবাদ জানান অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য। মাননীয় রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য্য এবং উদযাপনের ঐতিহ্যগত বর্ণাঢ্য আয়োজনের উল্লেখ করে বলেন যে- এটা এমন একটি সর্বজনীন আনন্দ উৎসব- যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই প্রানের আনন্দে এটা উদযাপন করে থাকে এবং এটি বাংলার, বাঙালির জীবনের চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, “মঙ্গল শোভাযাত্রা” পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, এটা বৈশাখী উদযাপনের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যের প্রতিফলন এবং ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে এখন তা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৪২৪ সালের শুভ শুচনায় তিনি সবার জন্য সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনা করেন।
এর পর পর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্বদেশী বাহারী পোশাক পড়ে হাতে রঙ্গিন বিভিন্ন ফেস্টুন, মুখোশ নিয়ে বাঁশী, ভেপুর আওয়াজ তুলে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” করে বাইরে থেকে ভেতরে এসে দর্শকদের প্রদক্ষিণ করা মঞ্চে আরোহন করে চিরপরিচিত, চিরনতুন সেই গানের সাথে……
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো… ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দূতাবাস পরিবার কর্তৃক আয়োজিত পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানে এই প্রথমবারের মতো “মঙ্গল শোভাযাত্রা”-র আয়োজন করা হয়। এছাড়া আগামী বছর ব্যাপক আয়োজনে বাইরে একটি “বাংলাদেশ কার্নিভাল” আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সামিয়া ইসরাত রণী ।
এরপর শুরু হয় আয়োজনের মূল সাংস্কৃতিক পর্ব, যেখানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করা হয়। যেসব দেশের প্রতিনিধি/শিল্পীরা সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশগ্রহন করে অনুষ্ঠানটিকে সর্বজনীন করে তুলেছন, তারা হলঃ
বাংলাদেশ – অদৃতা, লাবীবা, ইশাল, তুর্না এবং সিন্থিয়া।
নেপাল – আকৃতি খানাল।
মায়ানমার – মিঃ কো টু এবং তার দল।
শ্রীলংখা – উমান্ডা।
এপর্বে একক ও দলীয় সঙ্গীত, একক ও দলীয় নৃত্য, পুতুল নাচ ইত্যাদির পরিবেশনায় প্রানবন্ত হয়ে উঠে সন্ধ্যার আয়োজনটি। আর অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষন ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সেলিম চৌধুরীর চমৎকার সঙ্গীত পরিবেশনা। তিনি হাছন রাজা ও শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় গান পরিবেশন করে সবার মন কেড়ে নেন।
তার গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মনের ভেতর গুঞ্জরিত হচ্ছিল শাহ আব্দুল করিমের গানের কথাগুলো- “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”……। সাংস্কৃতিক পর্বে সবার চমৎকার পরিবেশনায় আপ্লুত হয়ে মুহূর্মূহু করতালিতে শ্রোতা-দর্শকগন তাদের অভিনন্দিত করেন। সাংস্কৃতিক আয়োজনে যারা যন্ত্র সঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন, তারা হলেনঃ- জনাব আবু রুমী এবং জনাব আশীষ বড়ুয়া।
এছাড়া পুরো আয়োজন এবং এর সফল মঞ্চায়ন জুড়ে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রমের স্পর্শ ছুঁয়ে ছিল। অতঃপর সম্পূর্ন স্বদেশী সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে সবাইকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করা হয় বাংলাদেশ দূতাবাস পরিবারের পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ দূতাবাস পরিবার কর্তৃক স্বদেশের ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখের আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসের আঙ্গিনায় দূতাবাস মিলনায়তে সেদিনের সন্ধ্যায় গড়ে উঠেছিল একটি ছোট্ট বাংলাদেশ, জমে উঠেছিল বিভিন্ন দেশের অতিথিবর্গের উপস্থিতিতে একটি চমৎকার সম্প্রীতির মিলনমেলা এবং সংস্কৃতির আনন্দ ধারায়, ঐতিহ্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল দূতাবাসস্থ বঙ্গবন্ধু মিলনায়তন!