বিচারক একা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না: প্রধান বিচারপতি

546

বিচারক ও আইনজীবীদের স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকে মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য বিচারক ও আইনজীবী সমাজের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিচারক একা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। বিচারের সকল পর্যায়ে আদালতের আইনজীবীর সহায়তার প্রয়োজন হয়।

image-123501-1545150893

মঙ্গলবার বিকালে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট দিবস ২০১৮ উদযাপন উপলক্ষে জাজেস স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দেন দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। সংবিধানের অধীনে ১৮ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট তার যাত্রা শুরু করে। উদ্বোধনের সেই ক্ষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তার সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আইনের শাসন কায়েমের জন্যই জাতিকে এত তাড়াহুড়া করে একটি সংবিধান প্রদান করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা আইনের শাসন বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছি এবং বাংলাদেশের স্বাধীন মাটিতে সুপ্রিমকোর্ট স্থাপিত হওয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। সুপ্রিমকোর্ট ছাড়া জাতি চলতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য হতে এটা পরিষ্কার যে, আইনের শাসন এবং সুপ্রিমকোর্ট ছাড়া একটি জাতি অগ্রসর হতে পারে না।’

সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, এখন আমাদের সামনে রয়েছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সুপ্রিমকোর্ট ও অধস্তন আদালতসমূহের দৃঢ় অবস্থান জনগণের মধ্যে আদালত সম্পর্কে গভীর আস্থার সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে জনগণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অধিকার সচেতন।

তিনি বলেন, এ দুইয়ের কারণে দেশের আদালতসমূহে মামলা দায়েরের পরিমাণ এখন আগের দশকের চেয়েও অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু যে হারে মামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে দেশে বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি।

তিনি বলেন, বাড়েনি অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। ফলে বিচারকদের মামলা নিষ্পত্তি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমি অনেক ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। অধস্তন আদালতসমূহে মূল মামলার নিষ্পত্তি বৃদ্ধিকল্পে জামিন ও অন্তর্বর্তীকালীন বিষয়াবলি শুনানি দিবসের দ্বিতীয়ভাগে এবং মূল মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ দিবসের প্রথম ভাগে করার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছি।

তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে এই বিষয়ে একটি সার্কুলার ইস্যু করা হয়েছে। এর ফলে মূল মামলার নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধান ১০৯ অনুচ্ছেদে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে তদবুনিয়াদে সুপ্রিমকোর্ট থেকে সব সময় মনিটর করা হচ্ছে যেন অধস্তন আদালতসমূহ তাদের কর্মঘণ্টার সবটাই বিচারিক কাজে ব্যবহার করে এবং অনর্থক যেন মামলার শুনানি মুলতবি না করে।’

চলতি বছরের মামলার পরিসংখ্যান নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার উদ্যোগের ফলে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে উচ্চ ও অধস্তন আদালতসমূহে মোট দায়ের হওয়া ১৩,৭১,৪৫৬টি মামলার বিপরীতে ৮৮৬,২৯৬টি মামলা ইতিমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমানে মামলার ক্লিয়ারেন্স রেট ৬৪.৬২ শতাংশ।

তিনি বলেন, মাত্র ১৭০০ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ জুডিশিয়ারির জন্য এটি একটি মাইলফলক অর্জন বলে আমি মনে করি। হাইকোর্ট বিভাগে প্রতি বৃহস্পতিবার ১৪টি বেঞ্চে মিস মামলা শুনানির জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছি। এতে করে জমে থাকা মামলার পরিমাণ কমে যাবে এবং মূল মামলা নিষ্পত্তিতে অধিক সময় ব্যয় করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা এমন আরও অনেক বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজকের এ অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সানুগ্রহ সম্মতিজ্ঞাপন করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে পারেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমার সহকর্মী বিচারপতিগণের পক্ষে আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সানুগ্রহ সম্মতি প্রদানের জন্য এবং পরে অসুস্থতাজনিত কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হতে পেরে লিখিত বক্তব্য প্রেরণের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি এবং তার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট দিবস উদযাপন-সংক্রান্ত জাজেস কমিটির সভাপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতি বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

এর আগে দুপুরে সুপ্রিমকোর্ট দিবস-২০১৮ এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কেক কেটে দিবসটির উদ্বোধন করেন তিনি। একইসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির আয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিরও উদ্বোধন করেন।

রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধন করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘রক্তদানের মতো মহৎ কাজ আর হতে পারে না। এখানে যারা রক্ত দান করছেন তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একইসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মসূচিও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই যারা আজ রক্ত দিচ্ছেন তাদের অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি এ ধরনের আয়োজনের জন্য অভিনন্দন জানাই সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিকে।’

আইনজীবী সমিতির সহসম্পাদক কাজী জয়নাল আবেদীনের সঞ্চালনায় ও সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি নূরুজ্জামান।

এছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর প্রতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর তারিখে সুপ্রিমকোর্ট দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় কোর্ট প্রশাসন। দিবসটি উপলক্ষে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.