বিসিসিডিআই বাংলা স্কুলের আয়োজনে বিজয় মেলা ও পৌষ পিঠা উৎসব
–এ্যন্থনী পিউস গমেজ, ভার্জিনিয়াঃ গত ১৭ই ডিসেম্বর,২০১৬, রোজ শনিবার ভার্জিনিয়ার এ্যনানডেল নোভা ক্যাম্পাস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিসিসিডিআই বাংলা স্কুলের বিজয় মেলা ও ১২তম পৌষ পিঠা উৎসব। বিপুল লোক সমাগমে আনন্দঘন আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এই বিজয় মেলা ও পিঠা উৎসব। সন্ধ্যার আয়োজন জুড়ে ছিল বিজয়ের গৌরবে আপ্লুত বিজয়ের আনন্দসহভাগিতার পাশাপাশি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সব বীর শহীদগন তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন- যাদের রক্তে ভেজা আমাদের বাংলার মাটি, যাদের মহান আত্মত্যাগের জন্যই আমাদের মুক্ত আকাশ, আমাদের স্বাধীনতা, যাদের কবরের উপড় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, সেইসব মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধ্যা নিবেদন করে নির্মিত অস্থায়ী প্রতিকী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করা। এছাড়া ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্বার আন্দোলন ও বিজয়ের স্মৃতিবিজরিত আনন্দধারায় পরিকল্পিত, আয়োজিত বিজয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এছাড়া বিশেষ আকর্ষন ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী শীতকালীন পিঠা উৎসব। বাংলার গ্রামীন জনপদের সহজ সরল অনারম্বর জীবনধারায় মায়া-মমতার স্পর্শে সিক্ত অন্যতম ঐতিহ্য এই পিঠা উৎসব। সময়ের পরিক্রমায় তা গ্রামীন সীমানা পেড়িয়ে স্থান করে নিয়েছে শহুরে মানুষের অন্তরে।এখন শুধু দেশের চত্বরে নয়, পিঠা উৎসব সবার হৃদয় জয় করে নিয়েছে এমনকি প্রবাসের মাটিতেও। এর মাঝে আমরা প্রবাসীরা হারিয়ে যাই সেই সুদূর অতীতে… স্মৃতি জাগানিয়া শীতের পিঠা-পায়েসের সুগন্ধ আবার ফিরে এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অতীতের মায়ায়। বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পায়েসে সেজে উঠেছিল যেসব পিঠাঘর, তারা হল- বিক্রমপুর পিঠা ঘর, রকমারী খাবার ঘর, পিঠা ঘর, ভাই ভাবির দোয়ান, ঝাল টক মিষ্টি, পিঠা পল্লী, রসনা বিলাস ইত্যাদি। আর যেসব বাহারী পিঠা টেবিল জুড়ে বিছিয়ে দিয়েছিল এক টুকরো শীতের বাংলাদেশ, তা হল- পাটিশাপটা, ভাপা, ফিলিস, দুধপাকন, নারিকেলপাকন, নকশী, মুগ ভাপা, হৃদয় হরণ, চিতই, দুধ চিতই, আলু পিঠা, ডিমের পিঠা, তিলের পিঠা, ঝাল পিঠা, মাছ পিঠা, গোলাপ পিঠা, মালপোয়া, নারিকেল, মেড়া, লবঙ্গ, খেজুর রসের নকশী পিঠা, বিবি খানা, ভিজা পিঠা, শামুক পিঠা, দিলখোলা পিঠা, মিটলোফ পিঠা, বালু পিঠা, ডাল পাক পিঠা, তিলপুলি, ঝুলঝুলি পিঠা, খিরমুখ, শৈলী পিঠা, মুগ পাকন, ঝাল পাটিসাপটা ইত্যাদি রকমারী বিভিন্ন রকমের পিঠা। এর মধ্যে যদিও কিছু কিছু পিঠা আমাদের চিরায়ত বাংলার পিঠা নয়, বরং প্রবাসী চিন্তার ফসল, বা ক্রিয়েটিভ প্রবাসী পিঠা বলা যায়। যতবারই পিঠা মেলায় গিয়ে হাজির হই, ততবারই একটা বিষয় আমাকে ভাবায়, তা হচ্ছে- এখানকার ব্যস্ত জীবনধারার মাঝে এত ধরনের পিঠা পায়েস তৈরী করার অনুপ্রেরণা এরা পায় কোথায়?! উত্তর খুঁজতে গিয়ে শুধুই মনে হয়েছে- এ আমাদের শেকড়ের টান, এ আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের গভীর ভালবাসা, এ আমাদের স্বদেশের যাপিত জীবনের স্মৃতির মায়া!
পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন এতদঞ্চলের জনপ্রিয় এবং সর্বজন পরিচিত সঞ্চালক- শতরুপা বড়ুয়া, আতিয়া মাহজাবিন নিতু এবং দীপক বড়ুয়া।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিকেই উপস্থিত ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিকী শহিদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান হয়। যেসব সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পন করেন, তারা হলেনঃ
বাংলাদেশ দূতাবাস, বিসিসিডিআই, বাগডিসি, বাই, আবিয়া, আগামী, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ্যলামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যলামনাই এসোসিয়েশন, উদয়ন ফাউন্ডেশন এবং এ্যম্পাওয়ার বাংলাদেশ। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন।বিশেষভাবে উল্লেখ্য আমাদের নতুন প্রজন্মের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও বেদিতে ফুল দিয়েছে এবং একটু করে হলেও তাদের চেতনায়ও ঠাই করে নিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় গাঁথা এবং এটাই আমাদের কাম্য, এটাই আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের ইতিহাস তুলে দেয়ার এক অনন্য উদাহরন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পূর্বে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজয়ের উপড় একটি চিত্রাংকন প্রতিযোগিতাঅনুষ্ঠিত হয়- “এসো আঁকি বিজয়ের রঙ্গে”। প্রচুর ছেলেময়েরা এতে অংশগ্রহন করে সবাইকে অভিভূত করে দেয়। চিত্রাংকনের চেয়ে যে বিষয়টি বেশী মূখ্য ছিল- তাহল, আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমাদের বিজয় গাঁথার ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, তাদের অন্তরের গভীরে শেকড়ের টান প্রোথিত করে দেয়া।
এরপর শুরু হয় বাংলা স্কুল মিউজিক এন্ড ড্যান্স এ্যকাডেমির ছাত্র-ছত্রীদের পরিবেশনায় বিজয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কালজয়ী, জনপ্রিয়, চেতনাদীপ্ত সংগ্রামী গানগুলোর মাঝে সবাই হারিয়ে গিয়েছিল সেই ’৭১ যুদ্ধের মাঠে, জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সেই সব স্মৃতি! যেসব গানের ডালিতে সাজানো হয়েছিল এপর্ব, তাহলঃ
“যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা”, “একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গায়”, “এই পদ্ধা, এই মেঘনা”, “সবুজ সুনীল মাখা ছবির মত আঁকা”, “আমার ভাইয়েররক্তেরাঙ্গানো”,“জয় বাংলা বাংলার জয়”, “ও বুড়ি গঙ্গা নদীরে আমি তোর বুকে ডিঙ্গা কেমনেরে ভাসাই”, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”, “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল”, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা”, ‘ওগো বীর মুক্তি যোদ্ধা”, “বিজয় দেখেছিলাম”, “যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা”, “সালাম সালাম হাজার সালাম”, “আমরা সবাই বাঙালি”,“প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে”, “রাঙ্গামাটির রঙ্গে চোখ জুড়াল”, “সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা”, “আমার দেশের মত এমন”, “সেই রেল লাইনের ধারে”, “সব ক’টা জানালা খুলে দাওনা”, “আমার বাংলাদেশের একতারার সুর”, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি”ইত্যাদি সমবেত এবং একক সঙ্গীতের মাধ্যমে এবং নৃত্যের ঝংকারে মেতে উঠেছিল মঞ্চের পুরোভাগ। অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল শুধুই স্বাধীনটা সংগ্রামেরস্মৃতি আর বিজয়ের উচ্ছাস।
অত্যন্ত প্রাঞ্জল, নান্দনিক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হল বিসিসিডিআই আয়োজিত বিজয় মেলা ও পৌষ পিঠা উৎসব।