বুদ্ধিজীবী দিবস, শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন

130

আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় যখন নিশ্চিত, ঠিক সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকাররা হাজার হাজার শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর চালায় নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন আর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

buddhijibi dibos

স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। ওরা ধরেই নিয়েছিল- বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ জাতি খুব কম সময়েই উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন করতে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বাসা ও কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষদের স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে গিয়েছিল।

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনদের লাশ খুঁজে পায়। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। সবার চোখ-হাত-পা বাঁধা; কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি আবার অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি।

১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। সেদিন যারা পৃথিবীর ইতিহাসের এ নিষ্ঠুর, অমানবিক, নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাদের মধ্যে ছিলেন-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জি সি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদিক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, আনন্দ পয়ান ভট্টাচার্য প্রমুখ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ঃ অধ্যাপক কাইয়ুম, হাবীবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. আবুল কালাম আজাদ, সাবেক গণপরিষদ সদস্য, মসিউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আমিনুদ্দীন, নজমুল হক সরকার, আবদুল হক, ডা. জিকরুল হক, সৈয়দ আনোয়ার আলী, এ কে সরদার প্রমুখ।

সাংবাদিকঃ সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার চিশতী, হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা আখতার প্রমুখ।

চিকিসাবিদঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, সামসুদ্দীন আহমদ, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, সোলায়মান খান, কায়সার উদ্দীন, মনসুর আলী, গোলাম মর্তুজা, হাফেজ উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল জব্বার, এস কে লাল, হেমচন্দ্র বসাক, কাজী ওবায়দুল হক, মিসেস আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী, আলহাজ্জ্ব মমতাজ উদ্দীন, হাসিময় হাজরা, নরেন ঘোষ, জিকরুল হক, সামসুল হক, এস রহমান, এ গফুর, মনসুর আলী, এস কে সেন, মফিজ উদ্দীন, অমূল্য কুমার চক্রবর্তী, আতিকুর রহমান, গোলাম সরওয়ার, আর সি দাশ, মিহির কুমার সেন, সালেহ আহমদ, অনীল কুমার সিংহ, সুশীল চন্দ্র শর্মা, এ কে এম গোলাম মোস্তফা, মকবুল আহমদ, এনামুল হক, মনসুর (কানু), আশরাফ আলী তালুকদার প্রমুখ।

সেনাবাহিনীর অফিসারঃ লে. জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর, বদিউল আলম, লে. কর্নেল হাই, মেজর রেজাউর রহমান, মেজর নাজমুল ইসলাম, আসাদুল হক, নাজির উদ্দীন, লে. নূরুল ইসলাম, কাজল ভদ্র, মনসুর উদ্দীন প্রমুখ।

সাহিত্যিকঃ পূর্ণেন্দু দস্তিদার, ফেরদৌস দৌলা, ইন্দু সাহা, মেহরুন্নেসা, আলতাফ মাহমুদ, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, জহির রায়হান (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়) প্রমুখ।

অন্যান্যঃ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (রাজনৈতিক নেতা), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী), শামসুজ্জামান (চিফ ইঞ্জিনিয়ার), মাহবুব আহমদ (সরকারি কর্মচারী), খুরশীদ আলম (ইঞ্জিনিয়ার), নজরুল ইসলাম (ইঞ্জিনিয়ার), মোজাম্মেল হক চৌধুরী (ইঞ্জিনিয়ার), মহসিন আলী (ইঞ্জিনিয়ার), মুজিবুল হক (সরকারি কর্মচারী) প্রমুখ।

এসব বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’। স্থপতি মো. জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদের নকশায় নির্মিত এ স্মৃতিসৌধ ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.