ভার্জিনিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী “মেজবান”
এ্যন্থনী পিউস গমেজ, ভার্জিনিয়াঃ প্রথম বারের মত গত ২ রা অক্টোবর, ২০১৬ ভার্জিনিয়ার আলেক জান্দ্রিয়াস্থ ফোর্ট হান্ট পার্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী “মেজবান”। যারাএই “মেজবান” আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বা উদ্যোক্তা, তারা হলেন, রেদোয়ান চৌধুরী, সঞ্জয় বড়ুয়া, প্রনব বড়ুয়া, মাহ্সাদুল আলম রুপম, জীবক বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, রাজিব বড়ুয়া, সরোজ বড়ুয়া সহ তাদের আরও কিছু বন্ধু-বান্ধব। দূর-দূরান্ত (ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকা, রীচমন্ড,প্যান্সিল ভেনিয়া) থেকে আসা বিপুল লোক সমাগমে, ব্যপক আয়োজনে অত্যন্ত চমৎকার অভিজ্ঞতার মাঝে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহুল প্রতিক্ষিত চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী “মেজবান”।
যারা সেদিনের এই আনন্দ আয়োজনে এসেছিলেন,
তারা মূলতঃ ঐতিহ্যবাহী “মেজবানে”র অভিজ্ঞতায় নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছেন, ফিরে গেছেন একরাশ আনন্দের স্মৃতি নিয়ে। সবাই এতটাই অভিভূত হয়েছেন এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনে যে, তারা প্রতি বছর এই “মেজবানে”র আয়োজনের আবদার করেছেন আয়োজকদের কাছে। যারা ব্যক্তিগত কারনে বা নিতান্তই অবহেলা করে আসেননি, তারা অনেকেই ফেইস বুকে ছবি আর ‘লাইভ’ দেখে আফসোস করে বলেছেনঃ-
“আহারে, কি মিসটা করলাম…! হায় আল্লাহ, তোমারা এত মজা করলা…? আগামী বছর ঠিক আইমু”…!
আসলেই না আসলে এই অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়। আমরা যারা মেজবানে গিয়েছি, সবাই অন্তর থেকে অনুভব করেছি, “মেজবান” একটি চমৎকার ঐতিহ্যবাহী সহ ভাগিতার আনন্দ আয়োজন।
মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে সকাল ৭টায় পার্কে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন আয়োজকগন সমস্ত আয়োজন নিয়ে। ফেইসবুকের পাতায় এসে গেল- “মেজবান অন”… শুরু হয়ে গেল রান্নার আয়োজন। এক হাজার লোকের রান্নার আয়োজন, এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এটা কোন রেষ্টুরেন্ট নয়, হোটেল নয়, কোন প্রফেশনাল কুক বা শেফ নেই- তারপরও এক অদম্য আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে আয়োজকরা শুরু করে দিয়েছেন রান্নার পালা খোলা আকাশের নীচে।
আকাশ সকালের দিকে একটু মেঘলা ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ধূসর আবহাওয়ার বিষন্নতা কাটিয়ে চারিদিকে ঝলমল করে উঠলো রোদেলা দুপুর। আয়োজকরা হাসিমুখে রান্নায় ব্যস্ত… ৫/৬টিপোর্টেবল গ্যাসের চুলায় বসানো বিরাট রান্নার হান্ডি থেকে উড়ছে ধোঁয়া… মসলা মাখানো লাল ঝোলে টগবগ করে ফুটছে মাংস। কাছে আসতেই বাতাসে ভর করে এলো সুস্বাদু রান্নার সুঘ্রান!!!! সুঘ্রান থেকেই আন্দাজ হয়ে গিয়েছিল রান্না চমৎকার হচ্ছে। হৈ চৈ করে আনন্দ অনুভবে চলতে থাকলো রান্নার পালা। রেদোয়ান চৌধুরী, মাহ্সাদুল আলম রুপম, রাজীব বড়ুয়া, সঞ্জয় বড়ুয়া, সেলিম আক্তার, জীবক বড়ুয়া, প্রনব বড়ুয়া, আব্দুল মান্নান, ফয়েজ আহমেদ সহ আরো বেশ কয়েক জন মিলে ব্যস্ত তখন এই সুস্বাদু রান্নায়। রেদোয়ান চৌধুরীর নেতৃত্বে এই রান্না চলছিল- থেকে থেকে তিনি মসলা দিচ্ছিলেন এবং সবাইকে গাইড করছিলেন। পেশাগত রান্নার প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছাড়া এতবড় রান্নায় মসলার আন্দাজ কি করে করছেন, তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। কিন্তু প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে দক্ষতার সাথে তাতে পরিচালনা দিচ্ছিলেন রেদোয়ান চোধুরী, সত্যিই অবাক হয়েছি। মাঝে মেঝে চলছিল রান্নার টেষ্টিং… কেমন হচ্ছে, লবন-মসলা সব ঠিক আছে কিনা, মাংস কতটুকু নরম হয়েছে ইত্যাদি। সবাই যখন টেষ্টিং করছিল… শুধু একটি আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল-
“উহুহুহু… মাই গড, সো টেষ্টি!”“উমমম………উমমম!”
যারা ঝাল একটু কম খান, তারা বলে ঊঠলো-
“খাইছে আমারে… কি ঝাল হইছেরে! মুখ জালাই ফালাইছি!”
অন্যেরা সঙ্গে সঙ্গে- “একটুন ঝাল না অইলে কি ভাল লাগবো নি?… ভাতের লগে কিছুটা কমি যাইব”।
সত্যিই আনন্দদায়ক এবং চমৎকার ছিল সে টেষ্টিং পর্ব। ক্লিক ক্লিক করে বেশ কিছু ছবিও উঠে এলো টেষ্টিং-এর স্বাভাবিক কিন্তু ভিন্নরকম মুখভঙ্গিতে… মাংসে কামড়রত অবস্থায়।
ধীরে ধীরে অতিথি দের আসা শুরু হয়ে গেল। তাদের সাথে আলাপচারিতার মাঝেই চলতে থাকলো রান্নার শেষ পর্ব। রান্না শেষ হতে হতে ইতি মধ্যে ভরে গেল পার্কের চত্বর, শেডের ভিতরে বাইরে তখন অনেক লোক, অডিটোরিয়ামে চলতে লাগলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। চারপাশে চলতে থাকে মানুষের আলাপচারিতা… গল্প-গুজব আর প্রান খোলা হাসির শব্দ এবং ছবি তোলার পালা, সেলফির পালা।
অতঃপর সেই বহুল প্রতিক্ষিত বিশেষ “মেজবানী” রান্নার মধ্যাহ্ন ভোজ। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই খাবার নিয়ে বসে গেল। কেউবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে অব্যাহত রাখল তাদের মুখ-রোচক আড্ডা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এখানে যেহেতু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশে সবাই আমন্ত্রিত ছিলে, তাই সবার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আয়োজনে গরুর মাংসের পাশাপাশি খাসীর মাংস এবং মুরগীর মাংস ও চনার ডাল রাখা হয়েছিল। সবার মুখেই চমৎকার রান্না এবং আয়োজনের প্রসংশা। সবাই অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে বিশেষ মেজবানী রান্নায় মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিল।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল শেডের ভিতরে মঞ্চে চট্টগ্রামের গানের ছন্দে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহন করেন, তারা হলেনঃ সন্তোষ বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, জুয়েল বড়ুয়া, সীমা খান, আবু রুমী, নাসের চৌধুরী, সুদীপ্তা বড়ুয়া, বনানী বড়ুয়া, সঞ্জয় বড়ুয়া, নিভা বড়ুয়া, লাকী বড়ুয়া, অদিতি বড়ুয়া, রবি রায়হান, তসলিম আহমদ, রিপু বড়ুয়া, মুক্তা বড়ুয়া, সুমী চৌধুরী, নাসরিন, প্রমুখ। তবলায় ছিলেন আশীষ বড়ুয়া, একর্ডিয়ানে আবু রুমী, বাঁশীতে মোহাম্মদ মজিদ।
উপস্থাপনা করেছেন ওয়াশিংটনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ, সবার পরিচিত ই-লার্নিং শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবক, ডঃ বদরুল হুদা খান এবং সাথে ছিলেন সবার পরিচিত, প্রিয় ছড়াকার সন্তোষ বড়ুয়া। তাদের দু’জনের অত্যন্ত চমৎকার এবং প্রানবন্ত উপস্থাপনায় পুরো অনুষ্ঠানই যেন প্রান পেয়েছিল। আর বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আয়োজনের সাজুয্যে পুরো অনুষ্ঠানে শুধুই চাটগাইয়া ভাষায় উপস্থাপনা করা হয়েছে, যা ছিল খুবই হাস্য রসাত্মক এবং চমকপ্রদ। সবাই অন্তর দিয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছেন। এছাড়াও ছিল র্যাফল ড্র-এর ফলাফল ঘোষনা এবং পুরস্কার বিতরন… এই পর্বেও চাটগাইয়া ভাষায় উপস্থাপন করে ডঃ বদরুল হুদা খান সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। অনেক হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে এপর্ব সম্পন্ন করা হয়।
পড়ন্ত বিকেলে অনুষ্ঠান শেষে আগামী বছরে “মেজবান”-এর প্রত্যাশা রেখে সবাই একে একে বিদায় নিয়ে চলে যান পার্কের সবুজ চত্বর ছেড়ে। পেছনে রয়ে যায় আয়োজকগন- সমস্ত কিছু সম্পন্ন করে দায়িত্ব পূর্ন করে যেতে হবে। সব কাজ শেষ করে সব শেষে বিদায় নিয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ান আয়োজকগন…… সবাইক ক্লান্ত, ফিরে গিয়ে একটু বিশ্রামের প্রত্যাশায় অপেক্ষমান… কিন্ত “দেয়ার আনন্দে”, “সহভাগিতার অনুভবে” এক পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি ছেয়ে আছে তাদের মন জুড়ে।
বাড়ী ফেরার পথে ড্রাইভ করতে করতে ভাবছিলাম… “আমরা বেশীর ভাগ সময় মানসিকভাবে কতটা ক্ষুদ্র বৃত্তে বিচরণ করি! পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ সব সময় অন্যের কাছ থেকে পেয়ে আনন্দ পেতে অভ্যস্ত, কিন্তু অন্যকে দিতে পারার যে নির্মল আনন্দ, তা হয়তো পাওয়ার আনন্দের চাইতে বহুগুন বেশী এবং তা অনুভব করার জন্য বড় মন প্রয়োজন, প্রয়োজন আকাশজোড়া মানসভূমির বিশাল ব্যপ্তি!”
ফটো ক্রেডিটঃ রাজীব বড়ুয়া, বিপ্লব দত্ত, এ্যন্থনী পিউস গমেজ।