ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত
মোহাম্মেদ আনাম,ওয়াশিংটনডিসি :কালের আবর্তন-চক্রে আবার ফিরে এলো ২১শে ফেব্রয়ারি ভাষার মাস। যা আমার ভাষা, মায়ের ভাষা। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও রক্তেভেজা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া ভাষা। যা আমাদের পরম পাওয়া ও স্বীকৃতি। যা আমাদের দিয়েছে বিশ্বে এক অনন্য পরিচিতি। আজ বাঙ্গালী বলে আমরা অহংকার করতে পারি। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আমরা সেই বিজয়ের এবং যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এটা পেয়েছি, তাদের স্মরণের দিন হিসাবে পালন করে আসছি। বাংলা মাসের সেই দিনটি ছিল ৮ই ফাল্গুন, ইংরেজি মাসের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার দিনটিকে আমরা পালন করছি ইংরেজিতে! কিন্তু সর্বস্তরের মানুষ যখন পক্ষ-বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে এটাকে মেনে নিয়েছে, সেখানে আমার অবাক বা প্রশ্নের অবকাশই নেই। মেনে নিয়েছি যুক্তিসংগত ভাবেই।
সাধারনতঃ আমরা জানি তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর রেসকোর্সের ভাষণ থেকেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত। ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল,”একটি অভিন্ন রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোন জাতিই দৃঢ় এবং অভিন্নভাবে টিকে থাকতে পারে না। তাই পাকিস্তানের অভিন্ন ভাষা হবে উর্দু”। ‘৪৮এর ২৪শে মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনী অনুষ্ঠানেও এরই প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু এখানে এই বক্তব্য বিনা প্রতিবাদে পার হতে পারলো না। সাথে সাথেই উপস্থিত ছাত্রদের ‘না’’না’ ধ্বনির মাঝে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
তারপরে শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দীন আহমদ, নঈমউদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং অলি আহাদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সম্বলিত স্মারকলিপিটিও প্রত্যাখ্যাত করা হয়। যা ছিল যুক্তিসংগত। কারণ তৎকালীন সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী মিলিত পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৬কোটি নব্বই লক্ষের মত। যার ৬৩.৬৮% বাংলাভাষী। আর ৬টি প্রধান ভাষার লোক মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৩৬.৩২%। সুতরাং যে কোন যুক্তিতেই বাংলার অগ্রাধিকার পাওয়াকে পারতঃ ক্ষমতার অহংকারে অস্বীকার করা হয়।
এবার একটু পিছনের দিকে দেখা যাক প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়ে ভাষা-গত দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল উর্দু,পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পশতু, বেলুচি এবং বহু-ভাষী অধ্যুষিত এবং পূর্ব পাকিস্তানে ছিল শুধুই বাংলা-ভাষীদের। দেশ ভাগের সময়ে বিভিন্ন ভাষা সম্বলিত মুসলিমরা বিপুল সংখ্যায় পাকিস্তানে প্রবেশ করে। কাশ্মীরের কিছু অংশসহ যারা পশ্চিমে মোজাহের এবং যে অল্প সংখ্যক বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারা বিহারী নামে অধ্যুষিত হয়। তারপরও বাংলা-ভাষীদের প্রাধান্য থেকে যায়। যা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।
পাকিস্তানের গন-বিধি আইন পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে (২৪শে ফেব্রুয়ারি ও ২রা মার্চ, ১৯৪৮) ভারত শাসনবিধির ২৯নং ধারা সংশোধনীতে ইংরেজি ভাষার সাথে উর্দুকে সংশ্লিষ্ট করার প্রস্তাবে পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, উর্দুর স্থলে বাংলাকে মর্যাদা দেওয়া হোক। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, যে কোন রাষ্ট্রের ভাষা সেই ভাষাই হওয়া উচিৎ, যাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ কথা বলে। কিন্তু এই সংশোধনী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও গন পরিষদের সহ-সভাপতি মৌলভী তমিজুদ্দিন খানের প্রবল বিরোধিতার মুখে বাতিল হয়ে যায়। বিকল্প প্রস্তাব আসে গোয়া ও ফিলিপাইনের অনুকরণে আরবী হরফে বাংলায় লেখার প্রস্তাবনা। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের সব লিখন প্রণালীই আরবী হরফে তাই ১৯৪৯ সালে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পাকিস্তানের সব ভাষার লিখন-প্রণালী আরবীতে করার জোর সুপারিশ করে। এবং এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যাল করে বেশ কয়েকটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মত একটি ঐতিহ্যবাহী এবং বিজ্ঞান সম্মত ভাষার ধ্বংস সাধন।
এরই প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি সম্মেলনে গ্রহণ করাও হয় কয়েকটি প্রস্তাব। ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ই নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রভাষা হবে ‘উর্দু’। প্রতিবাদে ৫১সালে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের মহা সম্মেলনে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহবান জানিয়ে বলেন, এটা হবে বাঙ্গালীদের গন-হত্যার সামিল।
পাকিস্তান গন পরিষদে বাংলার স্থান না হওয়াতে ১১ই মার্চ ঢাকায় ছাত্রসমাজের আহবানে ধর্মঘট, প্রতিবাদ মিছিল সহ বিক্ষোভ পালিত হয়। আসলে ধীরেন্দ্রনথ দত্তের সংশোধনী অগ্রাহ্য করার প্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষার দাবীতে এভাবেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ঘটে। ঐ দিন পুলিশের লাঠিচার্জ, ফাকাগুলি, টিয়ার গ্যাসসহ ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে আহত হন অনেক ছাত্র। আর গ্রেফতার হন শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবর রহমান সহ প্রথম সারীর নেতারা। কিন্তু তাতেও ভাষার জন্য দুর্দমনীয় বাঙ্গালীদের দমাতে না পেরে বাধ্য হয়ে নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের মাঝে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। পরিষদ জেলখানায় যেয়ে বন্ধী নেতাদের সম্মতি নিয়ে আসেন। ফলে চুক্তির বলে ১৪ই মার্চ সকল ছাত্র নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার।
এভাবেই আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সর্বস্তরে। এই পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ‘বিশ্ব-বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি’গঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে। তখন ১৯৪৯, ৫০ এবং ৫১ সালের ১১ই মার্চ পালিত হতো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে।
৪ঠা ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ দিবসের পর ১০ই ফেফ্রুয়ারি একমাত্র সরকার বিরোধী ইরেজী পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে এর মালিক কে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয় শেখ মুজিবর রহমান, মহীউদ্দিন আহমদ সহ আরো অনেককে। ভাষার প্রশ্নে এবং আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাকে সরকার বিচলিত হয়ে ২০শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় “সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের” এক জরুরী সভা ডাকা হয়। সভায় বেশীর ভাগ সদস্যই ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে মত দেন শুধু যুবলীগ নেতা অলি আহাদ যে কোন পরিস্থিতিতে পূর্ব কর্মসূচিতে অটল মনোভাব ব্যক্ত করেন সাথে থাকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আবদুল মতিন, গোলাম মাওলা। তোহা অনেকটা এড়িয়ে যান। গাজিউল হকের বক্তব্যে জানা যায়, সংগ্রাম পরিষদের এহেন সিদ্ধান্তে ছাত্রসমাজ হয়ে উঠেন বিক্ষুব্ধ, হলে হলে উত্তেজনা। পরে রাত ১টার দিকে ঢাকা হলের পুকুরের পাশে গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, কমরুদ্দীন শহুদ, এম, আর আখতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আবদুর মোমেন, এস,এ বারী এটি, মোহাম্মদ সুলতান এবং আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের।
তারপরের ইতিহাস প্রায় সবারই জানা।। গেটের সামনে পুলিশ থাকা স্বত্বেও পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে ১০ জনের এক এক দল গ্রেফতার বরন করতে লাগলেন। ট্রাকগুলি ভরে গেলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ করতে লাগলো। তাতেও ছাত্রদের নিরস্ত্র করা না গেলে পুলিশ ভিতরে প্রবেশ করতেই তা পুলিশ-ছাত্রের রণ-ক্ষেত্রে পরিণত হলো। নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীরা মেডিক্যাল কলেজ, কলেজের হোস্টেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে জমায়েত হতে থাকে। তাদের সাথে এবার যোগ দেয় প্রায় পুরো ঢাকার ছাত্রসমাজ সহ সকল পেশাজীবীরা। তখন এখানেই ঘটে ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। পুলিশ অতর্কিতে গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে অধ্যয়ন-রত ছাত্র মোহাম্মদ সালাউদ্দীনের মাথার খুলি উড়ে যায়, আহত অবস্থায় রাতে মারা যান আবদুল জব্বার, আবুল বরকত এবং রফিকউদ্দিন আহমদ। পরে মারা যান সালাম এবং গ্রেফতার করা হয় অগণিত। ২২শে ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের সামনের রাস্তায় শহীদ হন শফিউর রহমান। আরো একজন কিশোরের কথা শোনা যায় মতিউর নামে।
প্রথম শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য সাধারণ ছাত্ররা নির্মাণ করেন শহীদ মিনার। যা ২৩শে ফেব্রুয়ারির রাতের মধ্যেই নির্মিত হয়। যা সামরিক সেনারা ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে নিশ্চিণ্ণ করে দেয়।
শহরের নিয়ন্ত্রণ দেয়া সামরিক বাহিনীর হাতে কিন্তু এরপরও থেমে যায় বিক্ষোভ সারা দেশের একাত্মতায় তা রূপ নেয় আগ্নেয়গিরিতে। শহরের, গ্রামে-গঞ্জের ছোট ছোট শহরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শের রক্তাক্ত সংগ্রামের ফলেই ছাত্রদের ভাষা দাবীটি সর্ব-সাধারণের প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছিল। যা পরে গন-আন্দোলনের রূপ নেয়। এরই প্রেক্ষিতে আসে ঐতিহাসিক ২১ দফার। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, যার পরিণতি স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার মধ্য দিয়ে আজ আমাদের বাংলাদেশ। আমার মায়ের ও মুখের ভাষা বাংলা। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় এটাই প্রথম এবং শেষ ‘ভাষার জন্য রক্তদান’!