মহামারীতে সরকারি ব্যয় কমেছে ৭.৫৭%
দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে দাবি করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের বাকি সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
প্রথম প্রান্তিকে সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য সূচকগুলোর অবস্থাও ইতিবাচক।’ গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রথম প্রান্তিকের বাস্তবায়নের অগ্রগতিবিষয়ক প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অগ্রগতির যে চিত্র আমরা দেখলাম, তা থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায় আমরা সঠিক পথে রয়েছি।’
দেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলেও সংসদকে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে কয়েকটি ধাপে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিককে বিনামূল্যে টিকার আওতায় আনা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভ্যাকসিন বিতরণের খসড়া পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। ভ্যাকসিন সফলভাবে প্রয়োগ করার সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।’
এ সময় করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিন প্রয়োগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ উৎপাদনকারী অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরকারিভাবে আমদানির উদ্যোগ চূড়ান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি করোনাভাইরাসের টিকার ন্যায্য বণ্টনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা করা কভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটির (কোভ্যাক্স) আওতায় আরও সাড়ে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। পর্যাপ্তসংখ্যক পিসিআর ল্যাবরেটরি ও আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করেছে। তাছাড়া সরকার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দিকনির্দেশনায় করোনা প্রতিরোধ, সংক্রমণ হ্রাস ও চিকিৎসা প্রদানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি আমরা।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার ভ্যাকসিন আমদানি ও প্রয়োগের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এ সংক্রান্ত প্রকল্পটির কলেবর বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাকসিন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রয়োগসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে এই অতিরিক্ত বরাদ্দ ব্যয় করা হবে।’
করোনাভাইরাসের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতি শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারী থেকে উত্তরণে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো যথেষ্ট সময়োপযোগী ছিল। মহামারী সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা গেছে। সরকারের বাস্তবমুখী ও পর্যাপ্ত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিসঞ্চার, কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে পেরেছে।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি নির্দেশ করে যে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে এগিয়ে চলেছি। তবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে ভবিষ্যতে সরকারের অন্যতম কৌশল হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগে গতি আনা, দারিদ্র্য হ্রাস, রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার, কর ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাতের সংস্কার আনা।’
অর্থমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম প্রান্তিকে আমদানি ব্যয় কমেছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা কম হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম কমে যাওয়া হচ্ছে আমদানি ব্যয় কমার কারণ। করোনায় বৈশ্বিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। আবার গতবারের তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ৮ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ হয়েছে। কর-রাজস্ব ৪ দশমিক ১১, প্রবাসী আয় ৪৮ দশমিক ৫৪ এবং রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপিত চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রথম প্রান্তিকের বাস্তবায়ন অগ্রগতিবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে সরকারি ব্যয় কমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে তিনি সংসদে বলেন, সামনের দিনগুলোতে ব্যয় বৃদ্ধির জোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা থেমে নেই উল্লেখ করে প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর মোট পরিমাণ ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। জিডিপির ক্রমাগত হারে বেড়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে কিছুটা শ্লথ হয়েছে। তারপরও এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমাদের জিডিপি অনেক ভালো। বর্তমানে জিডিপি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে, বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৬ ডলার। আমাদের রপ্তানি আয় ৪৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়া। আমরা শিগগিরই অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব।’
মুস্তাফা কামাল বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। কভিড মোকাবিলায় সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।