শাহিন রহমান,ঢাকা,বাংলাদেশঃ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কলেজ ছাত্রী খাদিজা বেগম। রিতিমতো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অপারেশন শেষে মঙ্গলবার বিকেলে তাঁকে ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আগের দিন সিলেটে তাঁকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম । জনতা ঘটনার পরে ধাওয়া করে বদরুলকে উত্তম মাধ্যম দিয়ে পুলিশে দিয়েছে। গনপিটুনির শিকার হয়ে আহত বদরুল পুলিশ পাহারায় সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি হামলার কথা স্বীকার করে বলেন, ঘটনার দিন দুপুর থেকেই তিনি খাদিজার বাড়ি ফেরার পথে অপেক্ষা করছিলেন।
যে পথ ধরে খাদিজা বেগমের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল, সে পথের ওপর এখনও রয়েছে তাঁরই রক্তের ছোপ। সংকটাপন্ন অবস্থায় খাদিজা এখন শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়।হামলায় ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
সিলেটে ছাত্রলীগ নেতার হামলার শিকার খাদিজা বেগমের দ্বিতীয় দফা অস্ত্রো পাচার হয়েছে মঙ্গলবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। নিউরোসার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক রেজাউস সাত্তারের অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলছে। রেজাউস সাত্তার সন্ধ্যায় গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে রিসিভ করেছি। এখন ইলেকটিভ ভেন্টিলেশনে আছেন (লাইফ সাপোর্ট)। তাঁর মাথায় ও দুই হাতে অসংখ্য কোপের ক্ষত। জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে খাদিজার। এ ধরনের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ। ৭২ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
খাদিজা বেগম। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গত সোমবার পরীক্ষা দিতে সিলেটের এমসি কলেজে গিয়েছিলেন তিনি। পরীক্ষা শেষে ফেরার সময় এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে প্রকাশ্যে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা বদরুল আলম (২৬)। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। দীর্ঘদিন ধরেই খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ কেউ খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন। সেই ভিডিওটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠেছে সারা দেশ। ফেস বুকের কল্যাণে বিষয়টি এখন রীতিমতো টক অব দ্যা কান্ট্রি। অতি সম্প্রতি, চাপাই নবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী কণিকা ঘোষ, ঢাকার সুরাইয়া আক্তার রিসা ও মাদারীপুরের নিতু মণ্ডলের পর খাদিজার ওপর বখাটে ও উত্ত্যক্তকারীদের একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার সচিবালয়োে সাংবাদিকদের বলেন, অপরাধীকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানও এ ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট। তিনি কাউকে ছাড় দেন না।
এমসি কলেজের সাবেক ছাত্রি, তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেস্টা রাসেদা কে চৌধুরী এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হামলাকারীর বিচার দাবি করেন।
মুঠোফোনে ধারণ করা খাদিজাকে কোপানোর ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে পড়ে থাকা খাদিজাকে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করছেন বদরুল। ভিডিওতে অনেকের চিৎকার, কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেলেও ঐ সময়ে কেউই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাননি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য বলেছেন, কয়েকজন এগোনোর চেষ্টা করতেই চাপাতি হাতে বদরুল তাঁদেরও আঘাত করতে ছুটে আসেন। কয়েকজন দূর থেকে ঢিল ছুড়ে তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর বদরুল চাপাতি হাতে পালানোর সময় ছাত্ররা তাঁকে ধাওয়া দেয়। একপর্যায়ে ছাত্ররা তাঁকে ধরে ফেলে। সেখানে তিনি পিটুনির শিকার হন। পরে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
কলেজছাত্র ও স্থানীয় জনতা রক্তাক্ত খাদিজাকে দ্রুত সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে সোমবার রাতে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দেন স্বজনেরা। মঙ্গলবার সকালে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খাদিজার প্রতিবেশী ও স্বজনেরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন বদরুল। ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারিও উত্ত্যক্ত করার সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা বদরুলকে ধরে পিটুনি দেন। পরদিন বদরুল তাঁকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন জালালাবাদ থানায়। মারধরকারীদের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে বদরুল এ মামলা করেন।
জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন বদরুলের করা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে তিনি দাবি করেন, তিনি তখন এ থানার ওসি ছিলেন না।
বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি শেষ বর্ষের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক।
হামলার ঘটনায় খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস গতকাল হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বদরুলের বিরুদ্ধে শাহপরান থানায় মামলা করেন। শাহপরান থানার ওসি শাহজালাল মুন্সি বলেন, এ মামলায় বদরুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। হামলার কারণ জানতে তদন্ত চলছে।
এ দিকে, খাদিজার বাবা সৌদি আরব প্রবাসী মাশুক মিয়া মেয়ের জখম হওয়ার খবর শুনে দেশের উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছেন। আর মা মনোয়ারা বেগম অসুস্থ। মেয়েকে তিনি জীবিত ফেরত চান। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে খাদিজা দ্বিতীয়। সিলেটের জালালাবাদের আউশা গ্রামে খাদিজাদের বাড়ি।
হামলার ঘটনায় বদরুলকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে খাদিজার ওপর হামলাকারী বদরুল আলমের দ্রুত বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন সরকারি মহিলা কলেজ ও এমসি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নগরের জিন্দাবাজারের মহিলা কলেজের ছাত্রীরা ও দুপুরে টিলাগড় মোড়ে এমসি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আজ বুধবার সিলেটের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কালোব্যাজ ধারণ ও বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার ঘোষণা দেন তাঁরা। সিলেটের সব শ্রেণির মানুষ এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।