যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক গ্রেফতার

256
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘হত্যা ও ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন এক নাগরিককে। তার নাম মোহাম্মদ জুবাইর মনির (৬২)। বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়। সরকারি ডকুমেন্টে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। তার পরিবার দাবি করছে, ৯ মাস ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশির ভাগ সময় মনির দেশেই ছিলেন না। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।

i2ltLVFyyXuI

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে নিজের বাড়ি থেকে মনিরকে পুলিশ তুলে আনে ১৯শে ডিসেম্বর। তাকে এখন রাখা হয়েছে ঢাকার কেরানিগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে।তার পরিবারের দাবি, গত মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন বিরোধী দল বিএনপির এক নেতা। তার সঙ্গে মনির সাক্ষাৎ করার পরই তাকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পারিবারিক আইনজীবী জেসন এমার্ট বলেছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে মনির ছিলেন হতাশায়। এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘তিনি (মনির) নিরপরাধ। তাতে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রকাশ্য রূপ এটা।’
 আল জাজিরা লিখেছে, মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে এই বিচার নিয়ে সমালোচনা করেছে। এর মধ্যে একটি গ্রুপ এই বিচারকে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, এতে সুস্থ বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই আদালত অভিযুক্ত করেছে ৭৫ জনকে। মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ৫৩ জনকে। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

প্রসিকিউটর জিয়াদ উল মালুম আল জাজিরাকে বলেছেন, মনিরের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, আটকে রাখা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাতের অভিযোগ আছে। সে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল।

বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন মানুষকে টার্গেট করার অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রসিকিউটর মালুম। তিনি বলেন, যখন আমরা কাউকে বিচারের মুখোমুখি করি তখন আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চলি। রাজনৈতিক কারণে কাউকে আমি বিচারের মুখে দাঁড় করবো না। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার করবো। তাতে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন।

এ মামলার তদন্ত প্রায় শেষ হয়ে গেছে বলে জানান জিয়াদ উল মালুম। তিনি বলেন, তবে আমরা এখন পর্যন্ত যেসব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি তার কিছু এখনও যাচাই করে দেখছি।

মনিরের মেয়ে শ্রাবণ মনির। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, তার পিতা ছোটখাটো একটি ব্যবসা পরিচালনা করেন। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি বসবাস করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯১ সালে তিনি সেখানকার নাগরিকত্ব পান। শ্রাবণ মনির বলেন, নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তিনি দুটি স্টোর ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে তিনি বসবাস করেন এবং তার আছে দুটি ফার্ম। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তার কিছু ব্যবসায় স্বার্থ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি অফিস, একটি রাইস মিল ও মৎস্য চাষ।

শ্রাবণ মনির বলেন, তার পিতা ২০১৮ সালের ১৮ই নভেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন। তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল ৭ই জানুয়ারি। তার ভাষায় ‘আমার এক আঙ্কেল ১৮ই ডিসেম্বর আমাকে ফোন করেন। জানান, বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ খবর শুনে আমি হতাশ।’

পিতা মনির হোসেনের জন্ম সনদ, যুক্তরাষ্ট্রে তার ন্যাচারালঅইজেশন সনদ ও পাসপোর্টের কপি আল জাজিরাকে দেখান শ্রাবণ। ওই পাসপোর্টে দেখা যায়, জুবাইর মনিরের জন্ম ১৯৫৮ সালের ৩রা জানুয়ারি। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। এ নিয়ে শ্রাবণ প্রশ্ন তোলেন। জানতে চান, যখন তার বয়স ১৩ বছর তখন কিভাবে সে যুদ্ধাপরাধ করতে পারে?

শ্রাবণ আরো দাবি করেন ৯ মাস ধরে চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার পিতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিলেন না। ‘১৯৬৯ সালে যখন তার বয়স ১২ বছর, তখন তিনি তার এক আঙ্কেলের সঙ্গে বসবাস করছিলেন পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানকার স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের অক্টোবরের আগে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। এর দু’মাস পরে যুদ্ধ শেষ হয়।’ এসব দাবি করলেও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি শ্রাবণ।

যুদ্ধের সময় মনিরের বয়স ও তার অবস্থানস্থলের বিষয়ে আইসিটির প্রসিকিউটর মালুম বলেন, তিনি এমনটা দাবি করতে পারেন। যদি তাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে তাদের আইনজীবী তা আদালতের সামনে উত্থাপন করতে পারেন।

শ্রাবণ স্বীকার করেন তার দাদা আবদুল খালিক মনির ১৯৭১ সালে সুপরিচিত একজন স্থানীয় রাজনীতিক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের তিনি সহেযোগিতা করেছিলেন। এ জন্যই তার পিতাকে গ্রেফতারকরা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন শ্রাবণ।

শ্রাবণ আরো বলেন, আমি এইসব গল্প শুনে বড় হয়েছি, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের পর স্বাধীনতাপন্থিরা আমার দাদাকে অন্য ৯৬ জনের সঙ্গে হত্যা করেছিলেন।

এসব অভিযোগ আদালতের কাছে তুলে ধরা উচিত বলে জানান প্রসিকিউটর মালুম।

ওদিকে মনিরের সঙ্গে সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রের কনসুলার কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দেয়া হয় নি। আগামী ২০শে জানুয়ারি প্রথমবারের মতো আইসিটিতে তোলার কথা রয়েছে মনিরকে। তার মার্কিন আইনজীবী জেসন এমার্ট বলেন, যত দ্রুত সম্ভব মনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের। তাকে আটক রাখতে দেয়া উচিত নয়। মনির যেহেতু একজন মার্কিন নাগরিক তাই তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার দাবি করা উচিত। নিশ্চিত করা উচিত যে, তিনি যেন যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারেন।

 

 

Promoted Content

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.