রাখাইনে এবার গ্রামে গ্রামে মর্টার হামলা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে এবার মর্টার হামলা শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সেখানে খাদ্য সরবরাহে বাধা দিচ্ছে তারা। অব্যাহত রয়েছে ধরপাকড়, চলছে লুটপাট।
সব মিলিয়ে রাখাইনে চলমান সংকটের মধ্যে আবারও মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সোমবার প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে গুরুতর এ অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠীটি জানায়, ২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে যেসব সেনা ইউনিট রাখাইনে বর্বরতা চালিয়েছিল, তাদেরই আবার সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ভয়ে-আতঙ্কে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২০০ মানুষ।
চলতি বছর জানুয়ারির শুরুতে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এরপর থেকে নতুন করে দমনপীড়নে নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অ্যামনেস্টির সংকট প্রতিক্রিয়াবিষয়ক পরিচালক তিরানা হাসান বলেছেন, ‘সম্প্রতি এ অভিযান আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কোনো রকম মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না। যে কোনো পরিস্থিতিতে বসতিপূর্ণ গ্রামের ওপর গোলা নিক্ষেপ ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রাখা সমর্থনের অযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।’
‘মিয়ানমার : ফ্রেশ এভিডেন্স অব ভায়োলেশনস অ্যামিড অনগোয়িং মিলিটারি অপারেশন ইন রাখাইন স্টেট’ শিরোনামের এ রিপোর্টে অ্যামনেস্টি বলেছে, রাখাইনে বেসামরিকদের আটক করার ক্ষেত্রে অস্পষ্ট ও নিষ্পেষণমূলক আইন ব্যবহার করছে নিরাপত্তারক্ষীরা। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরও এসব ঘটছে। ওই রিপোর্টে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে মিয়ানমারের জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানানো হয়।
অ্যামনেস্টি লিখেছে, ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসের দিন রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে চারটি পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান আর্মির হামলায় ১৩ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়। এর চার দিন পর আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাদের নির্মূলে অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, এ অভিযানের ভয়ে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ হাজার ২০০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারা ম্রো, খামি, দায়িংনেট ও রাখাইনসহ বৌদ্ধ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোক।
অ্যামনেস্টি এমন ১১ জন ভুক্তভোগী, মানবিক সহায়তা কর্মকর্তা ও স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে। অধিকাংশই বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামে মর্টার শেল নিক্ষেপ ও খাদ্য প্রবেশে বাধা দিলে তারা পালিয়ে যায়। ম্রো জনগোষ্ঠীর ২৪ বছর বয়সী একজন জানান, ১৩ জানুয়ারি থা ইয়েট পিইন গ্রামে কয়েকটি আর্টিলারি বা মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন তিনি। পরে সবাই পার্শ্ববর্তী ডান থেইন গ্রামের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরে আশ্রয় নেন। ২১ ডিসেম্বর থা লু চং গ্রামে মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন ৬৪ বছর বয়সী কৃষক। ২৬ জানুয়ারি থা মি হা গ্রামে মর্টার বিস্ফোরণে ৭ বছরের শিশু নাইং সোয়ে আহত হয়েছে।
মর্টার হামলার পাশাপাশি সেনা সদস্যরা গ্রামে গ্রামে লুটপাটও অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ অ্যামনেস্টির। এসব গ্রামের ঘরে ঘরে ঢুকে অর্থকড়ি লুট করছে তারা। স্কুল, বাড়িঘরে ভাংচুর চালিয়েছে। কায়েকতাউ গ্রামের ৩৪ বছর বয়সী নারী বলেন, চাল কিনতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডিসেম্বর থেকে রাখাইনের প্রধান খাদ্য ধান ও বাঁশ চাষে বাধা দিচ্ছে সেনাবাহিনী।
ওই নারী জানান, ‘গ্রামে চাল নিয়ে ঢোকার জন্য তুং মিন কু লার গ্রামের পাশে পুলিশ চেকপোস্টে অনুমতি চান তিনি। পুলিশ জানায়, সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে এলে সর্বোচ্চ ৬ পিয়ি (বার্মিজ ইউনিট, যা ২.৬৫ লিটার কনটেইনারের সমান) চাল প্রবেশে অনুমোদন দেবে।’