রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষক দিবস’পালিত
সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ড. জোহা ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়াশুনা করে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫০ সালের প্রথম দিকেই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তার পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে আসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এরই অংশ হিসেবে ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নে স্নাতক (সম্মান) ভর্তি হন। এরপরই তার পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ড.জোহা ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজে উচ্চ ডিগ্রি লাভের জন্য একটি স্কলারশিপ পান এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যে তাঁর গবেষণার মাধ্যমে পিএইচডি ও ডিইসি ডিগ্রি লাভ করে ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এরপর নিযুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি, আগের রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রায় হাজার দুয়েক ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন হল থেকে এসে সমবেত হয় এবং চারজন করে লাইনে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ ও ইপিআর মিছিলে বাধা দেয়, সেনাবাহিনীর জোয়ানরাও মিছিল ঠেকাতে ছাত্রদের দিকে রাইফেল তাক করে।
ড. জোহা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে একবার ছাত্রদের পরিস্থিতির ভয়াবহতা আবার কখনও কর্মরত সেনা কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের বার বার বলছিলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে ক্যাম্পাসের দিকে।দ কিন্তু অবাঙালি সামরিক অফিসারটি প্রথম থেকেই উত্তেজিত ছিলেন এবং তিনি বার বার জোয়ানদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলছিলেন।
ড. জোহা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অনেক কষ্টে এক সময় ছাত্রদের বুঝিয়ে গেটের ভেতরে পাঠাতে সক্ষম হলে পরিস্থিতি যখন শান্ত হওয়ার পথে তখনই হঠাৎ বেজে ওঠে গুলির শব্দ। মুহূর্তের মধ্যেই আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-শিক্ষকদেরে মাঝে। দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় এবং তাকে মরণাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়েই ছাত্র-জনতা ভিড় জমায় হাসপাতালে।
ইতোমধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অপারেশন থিয়েটারে ইন্তেকাল করেন ড. জোহা, কিন্তু নাম লিখিয়ে যান ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তার সেই রক্তস্নাত পথ ধরে গণআন্দোলন গণঅভ্যুথানে পরিণত হয়।
২০০৮ সালে ড. জোহাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানায় বাংলাদেশ সরকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে তার নামানুসারে এবং সেই থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।