রোহিঙ্গাদের সবাইকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতেই হবে:সাইমন
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী সাইমন হ্যানশ গত শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য মিয়ানমারকে চাপ দিতে দেশটির ওপর যথার্থ অবরোধ আরোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করছে এবং এ জন্য মিয়ানমার পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র।ওই সংবাদ সম্মেলনেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন আগামী ১৫ নভেম্বর মিয়ানমার যাচ্ছেন। এর আগেই পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য টিলারসন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন।
হিদার নোয়ার্ট বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কেবল পররাষ্ট্র দপ্তরই নয়, হোয়াইট হাউস, ক্যাপিটল হিলও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন এশিয়া সফর করছেন, তখন এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো রোহিঙ্গা সংকট।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রী সাইমন হেনশের নেতৃত্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রমবিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি স্কট বাসবি, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি টম ভাজদা এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক ব্যুরোর অফিস পরিচালক প্যাট্রিসিয়া মেহোনি এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করছেন।
সফরের শেষ পর্যায়ে গতকাল ঢাকায় আমেরিকান ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সাইমন হ্যানশ বলেন, এটি তাঁদের দৃষ্টি খুলে দেওয়ার মতো সফর।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করছেন। বাস্তব পরিস্থিতি জানতে তাঁরা মিয়ানমার সফর করেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের কাছে পাঠাবেন। তিনি বলেন, এ সংকট অত্যন্ত জটিল। মিয়ানমারে সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসনে রূপান্তর, রাখাইন রাজ্যে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে মতপার্থক্য এবং এ বিষয়ে রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানগত পার্থক্য পরিস্থিতিকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে গুরুতর কিছু ঘটেছে বলেই মাত্র দুই মাসের মধ্যে সেখান থেকে ছয় লাখ লোক এ দেশে চলে এসেছে। বর্তমান পদে সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বের অনেক দেশেই শরণার্থী সমস্যা পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু এত বড় মাত্রার সংকট কখনো দেখিনি। ’সাইমন হ্যানশ বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার সরকারের কাছে কিছু বিষয় তুলে ধরেছি। প্রথমত, রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফেরানো তাদেরই দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে দেওয়া উচিত। তাদের অবশ্যই ফিরতে দিতে হবে। তাদের বাড়িঘর, গ্রাম পুনর্নির্মাণে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বশেষ, রোহিঙ্গাদের সফলভাবে রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে সেখানে রাজনৈতিক পুনর্মিলন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে এসে তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছাড়াও কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন।
সাইমন হ্যানশ বলেন, ছয় লাখ রোহিঙ্গা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে আছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। রোহিঙ্গাদের এই সংকটের সময় বাংলাদেশ যেভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে সে জন্য তিনি এ দেশের সরকার ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘এটি ভয়ংকর পরিস্থিতি। আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াই সেরা সমাধান। ’ তিনি মিয়ানমার-বাংলাদেশ আলোচনা অব্যাহত রাখা, দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করা এবং সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় জোর দেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে সাইমন হ্যানশ বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়নের জোরালো সমর্থক।
রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান পেতে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর কিভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে জানতে চাইলে সাইমন হ্যানশ বলেন, ‘চাপ’ শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক কি না, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হলো, রোহিঙ্গাদের সবার স্বেচ্ছায় নিরাপদে ফিরে যেতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করা। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে উৎসাহিত করতে আমরা কূটনৈতিক ও অন্যান্য ব্যবস্থা কাজে লাগাচ্ছি। ’
যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে কি না—জানতে চাইলে সাইমন হ্যানশ বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জবাবদিহিতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমরা বিশ্বাস করি। অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আমরা অবরোধ কাজে লাগাব। ’
রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার অভিযোগ ও অবরোধ আরোপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাইলে সাইমন হ্যানশ বলেন, ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা আমাদের অবরোধ ব্যবস্থা কাজে লাগাব। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন, পুনর্মূল্যায়ন করছি। কংগ্রেসে বেশ কিছু ব্যবস্থা আছে, যা আমরা কাজে লাগাতে পারি। ’ তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার কক্সবাজারে আমরা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাহিনিগুলো ভয়াবহ। যৌন নির্যাতন, হত্যাসহ অন্যান্য নৃশংসতার ঘটনা শুনে চোখে পানি ধরে রাখাও কষ্টকর। ’
বাংলাদেশের কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে—মিয়ানমারের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাইমন হ্যানশ বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের দায় মিয়ানমারের। প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা এবং প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত অঞ্চল নিশ্চিত করার দায়িত্ব মিয়ানমারের। ’ বাংলাদেশ তহবিল সংগ্রহ করছে—মিয়ানমারের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই অর্থ বাংলাদেশ সরকারের কাছে আসছে না, সহায়তা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে যাচ্ছে। ’
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেন, ‘আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, এটি ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নয়, প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের কাছেও এটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ’ তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন এশিয়া সফর করছেন তখন তিনি অংশীদার ও মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে অনেক ইস্যুতে আলোচনা করবেন। আমি জানি, হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে আলোচনা করেছে। আপনারা দেখছেন, এ সংকট নিয়ে হোয়াইট হাউস থেকেও বিবৃতি আসছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রশ্ন পাচ্ছি। শুধু পররাষ্ট্র দপ্তর, হোয়াইট হাউসই নয়, ক্যাপিটাল হিলও এ সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। ’
অংশীদারি সংলাপে গুরুত্ব পাবে রোহিঙ্গা সংকট : হিদার নোয়ার্ট জানান, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৃতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন রবিবার বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বার্ষিক অংশীদারি সংলাপে যোগ দেবেন। সেখানেও এ সংকট বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, সরকার ও বিশ্বজুড়ে মানুষকে নাড়া দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মহানুভবতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। ’ তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, জাতিসংঘ, বেসরকারি সংস্থাসহ অন্য অংশীদাররা আশ্রিতদের চাহিদা পূরণ এবং মানবিক সংকটের একটি সমাধান খুঁজে পেতে কাজ করছে।