আশিক মাহমুদ:নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গা ইস্যুতে আবারও কৌশলী অবস্থান নিয়েছে ভারত। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এজেন্ডা নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে দেশটি। এর মাধ্যমে ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঠিক কি ভূমিকা পালন করছে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা ভারতের অবস্থানকে অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ বলে মন্তব্য করেছেন।তবে জাতিসংঘে ৫৭ মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসির আহবানে এ ভোটাভুটিতে নৈতিকভাবে নিপীড়ক রাষ্ট্র মিয়ানমারের পরাজয় হয়েছে। তারা চীন-রাশিয়াসহ মাত্র ১০টি দেশের ভোট পেয়েছে।
বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ১৩৫টি দেশ। মাত্র ২৬টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
ফলে ১৩৫-১০ ভোটে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধের প্রস্তাব পাস করেছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের ভোটদান থেকে বিরত থাকা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার শুরু থেকে ভারত পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়ে জোর গলায় বলে আসছে তারা বাংলাদেশের পাশে আছে। কিন্তু, ভোটাভুটিতে গিয়ে তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল।
সারা বিশ্ব যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব, সেখানে ভারত কেন নিরব ভূমিকা পালন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত বাণিজ্যিক কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে এমন ‘কৌশলী’ অবস্থান নিয়েছে ভারত।
তাদের মতে, দু’দেশের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য তারা কোনো একটি দেশের পক্ষ নিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে রেজ্যুলেশন পাস হয়েছে, তাতে সার্কের সদস্যভুক্ত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে। আর ভারতের কারণে ভোটদানে বিরত থেকেছে নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা।
আর আসিয়ানভুক্ত দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেই পক্ষে এবং মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত থেকেছে চীনের ঘনিষ্ঠ সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান আসলে কি? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা নিরপেক্ষই মনে হচ্ছে। কারণ ভারতের কাছে মিয়ানমার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের অবস্থানও একই। এজন্যই হয়তো তারা কোনো একটি রাষ্ট্রকে বেছে নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের এই কৌশলী অবস্থান বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইতিবাচকই বলতে হবে। কারণ সংঘাত শুরুর দিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। সেখান থেকে দেশটির অবস্থানে এখন কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা একটা পরিষ্কার ইঙ্গিত, ভারত একটা মানবিক ইস্যু ও বাংলাদেশের স্বার্থজড়িত বিষয়ে দ্বিধার মধ্যে আছে এবং নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করেছে।’
‘ভারত যে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাংলাদেশের বিপক্ষে যায়নি। এই ধরনের নিরবতা অনেকটা বাংলাদেশের পক্ষকে সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। তারা যদি এই ইস্যুতে আমাদের বিপক্ষেও চলে যায়, আমাদের কিন্তু কিছু করার নেই। তবে এটা সত্য, ভারত সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।’- যোগ করেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাণিজ্যিক কোনো কারণে এমন কৌশলী ভূমিকা পালন করছে কি না জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নিশ্চয়। এটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব স্বার্থ রয়েছে। মিয়ানমারেও তাদের একই রকম স্বার্থ রয়েছে। সমরাস্ত্রসহ মিয়ানমারে ভারতের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। সেটিকে তারা সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে চাইছে।’
চলতি বছরের আগস্ট মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হয় সেনা অভিযান। অভিযান শুরু হলে হত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
সাম্প্রতিক বর্বরোচিত এ জাতিগত নিধনে দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় উগ্রবাদী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীও। আক্রান্ত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁচাতে ও আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত খুলে দেয় এবং তাদের পাশে দাঁড়ায়।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন বন্ধের আহবান জানালেও দেশটি তাতে সাড়া দেয়নি। একইসঙ্গে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
এ অভিযান শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাৎক্ষণিক সফরে মিয়ানমার যান। সেখানে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সঙ্গে একান্তে বৈঠকে মিয়ানমারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। এটি ছিল ক্ষমতায় আসার পর মোদির প্রথম মিয়ানমার সফর।
এদিকে, প্রতিবেশী মিত্র দেশে ভারতের অবস্থান নিয়ে শুরুতেই বাংলাদেশ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারণ এ সংকটে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে ভারতকে সবার আগে কাছে পাওয়ার আশা করছিল বাংলাদেশ। তখন মোদির মিয়ানমার সফরের এক সপ্তাহ পরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে দিল্লি থেকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক ফোনালাপে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
পরে গত ২২ অক্টোবর তিন দিনের সফরে তিনি ঢাকা আসেন। তবে সুষমা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকারের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের পক্ষে তার সরকারের ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশীরা পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য পায়, আর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাধান্য সবার আগে।’
এরপর গত ২ নভেম্বর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী নীতিতে এখন বাংলাদেশই সবার আগে।’
কিন্তু, বৃহস্পতিবারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে ভোট দানে বিরত থাকার কারণে ভারতের অবস্থান নিয়ে আবারও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল বাংলাদেশ।