সংসদ নির্বাচন: যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা নির্বাচনে ভোট দিতে না পেরে হতাশ
বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারছেন না বলে হতাশা প্রকাশ করছেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীরা অভিযোগ করছেন তাদের ভোট দেবার সুযোগ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে সুযোগ তাদের জন্য অধরাই থেকে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ একমাত্র পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের অভিযোগ : ডাকে পাঠানো ব্যালটপেপার হাতে পেলেও তা ডাকযোগে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যথেষ্ট সময় তাদের হাতে দেয়া হয় নি।
ফলে বেশিরভাগ প্রবাসী ভোটারের আশংকা তাদের ব্যালট কাগজ ৩০শে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছানো “এক অর্থে অসম্ভব”।
প্রবাসী যেসব বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন এবং ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়েছেন – একমাত্র তারাই নির্বাচনের সময় ভোট দিতে পারেন। যারা যুক্তরাজ্যে বসে সেই ভোট দিতে চান, তাদের একমাত্র সুযোগ পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেয়া।
যুক্তরাজ্যে যেসব সংগঠন তাদের ভোটাধিকারের দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার গত কয়েক দশক ধরে, তাদের মধ্যে একটি হিউম্যান রাইটস অ্যাণ্ড পিস ফর বাংলাদেশ ইউকে।
সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রহমত আলী বলেন, আসন্ন নির্বাচনে প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটদান সম্পর্কে অবহিত করতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ৩০শে নভেম্বর সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করলেও স্থানীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রবাসীদের মধ্যে সময়মত সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কোন ধরণের প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয় নি।
“এই পোস্টাল ভোট সম্পর্কে প্রবাসী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণা চালানোর কথা সেই নির্দেশে বলা হয়েছিল। কিন্তু দু:খের এবং হতাশার বিষয় যে লন্ডনে যে বাংলাদেশ হাইকমিশন আছে, ওনারা এ ব্যাপারে সময়মত কোনকিছুই করেন নি। এটার কোন প্রমাণও নাই। পত্রপত্রিকাতেও আমরা কিছু দেখি নাই। আর বিভিন্নভাবে প্রচার প্রচারণা চালানোর যে সময় ছিল সেটাও চলে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম অনেক প্রবাসী এর মাধ্যমে সচেতন হবেন এবং ভোট দিয়ে দেবেন।”
“আমারও এই ভোট দেবার অধিকার আছে। কিন্তু এই ভোটের একটা সময়সীমা আছে। এখানে অনেকেই জানেন না সেই পোস্টাল ভোট কীভাবে দিতে হয়, পোস্টাল ভোটের সময়সীমাই বা কী, কোন্ সময় তা পাঠাতে হয়। সেই বিষয়গুলা যদি একজন মানুষ না জানে, তাহলে তো তার ভোট দেয়া যায় না,” জানান মি: আলী।
তবে লণ্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তারা নির্বাচন কমিশনের জারি করা পরিপত্র হাতে পেয়েছে ৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো এই পরিপত্র সাত তারিখ তারা দূতাবাসের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে।
লণ্ডনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনিম বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা কীভাবে ভোট দিতে পারবেন বা পোস্টাল ব্যালট কীভাবে সংগ্রহ করবেন – এ নিয়ে তারা দূতাবাসের সঙ্গে এর আগে কোন যোগাযোগ করেন নি।
তিনি বলেন, “এরপর যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি মত বিনিময় সভা করি, তখন পোস্টাল ব্যালটে কীভাবে ভোট দিতে হবে তা নিয়ম আমরা তুলে ধরি। আমরা জানিয়ে দেই যে এই পোস্টাল ব্যালটের পুরো বিষয়টা ডাকব্যবস্থার মাধ্যমেই হতে হবে। তখন স্থানীয় সাংবাদিকদের দিক থেকে একটা প্রশ্ন এসেছিল যে প্রথম দরখাস্তটা ইমেলের মাধ্যমে করা যাবে কীনা, তাহলে সময় কিছুটা বাঁচানো যাবে।”
“এ বিষয়টা নিয়ে আমরা ইমিডিয়েটলি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করি- প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে কথা বলি। এবং অন্তত প্রথম ধাপটা ইমেলের মাধ্যমে করার বিষয়টি বিবেচনার সুযোগ আছে কীনা সেটা জিজ্ঞেস করি। উনি জানান, বিষয়টিতে ওনার হাত-পা বাঁধা। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী- পরিষ্কার লেখা আছে – তিনটি পর্যায়ই পোস্টের মাধ্যমে হতে হবে।”
সাঈদা মুনা তাসনিম বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন ১৩ই ডিসেম্বর। এবং তিনি বলেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভোটারদের দরখাস্ত “তিন-চারদিনের মধ্যে ডাক মারফত তাদের হাতে পৌঁছে গেলে, প্রতিটা পদক্ষেপ তারা তিন দিনে শেষ করবেন। অর্থাৎ তিনদিনের মধ্যে ব্যালট পাঠাবেন এবং ওনার হিসাবমত তাতে করে ৩০শে ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট দেওয়া সম্ভব হবে।”
কিন্তু মি: রহমত আলী বলছেন, এ সময়ের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই এবারের সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়া যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ প্রবাসী ভোটারদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি মনে করেন প্রবাসীদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনের হাতে আরও সময় নিয়ে এই পোস্টাল ব্যালট প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করা উচিত ছিল।
মি: আলী বলছিলেন তাদের সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাণ্ড পিস ফর বাংলাদেশ ইউকে প্রবাসীদের ভোটের অধিকার কার্যকর করার দাবিতে প্রচার অভিযান চালাচ্ছে ২০১১ সালের পর থেকে।
তাদের দাবির মূল লক্ষ্য : যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীরা যাতে তাদের পাসপোর্ট দেখিয়ে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে এবং তাদের নাম ভোটার তালিকার অর্ন্তভূক্ত করতে পারেন এবং দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের ভোট দিতে পারেন।
তবে লন্ডনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত বলছেন, বর্তমান বিধি অনুযায়ী প্রবাসীদের তাদের নিজেদের জেলার রির্টানিং অফিসারের কাছে ভোট দিতে চেয়ে দরখাস্ত পাঠাতে হবে। যিনি ওই দরখাস্তের ভিত্তিতে তাদের পোস্টাল ব্যালটপত্র পাঠাবেন এবং ভোটারকে তার ভোটসহ ব্যালটপত্র ফেরত পাঠাতে হবে তার এলাকার রির্টানিং অফিসারের কাছে এবং সবই হতে হবে ডাক মারফত।
“বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার রির্টানিং অফিসারের নাম, যোগাযোগ ইমেল ও ফোন নম্বরসহ গোটা পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে আমরা যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছি,” জানান সাঈদা মুনা তাসনিম।
মি: আলী বলছেন প্রবাসীদের অন্যতম মৌলিক একটি অধিকার- ভোটাধিকার। যুক্তরাজ্যে প্রায় ৭ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশীর বাস।
মি: আলী বলেন যে মামলার মাধ্যমে প্রবাসীরা তাদের ভোটাধিকার পেয়েছেন, সেই রিট মামলাটিও করেছিলেন একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশী আলী রেজা খান। তিনি হাইকোর্টে এই মামলাটি দায়ের করা পর সেই মামলার ফলশ্রুতিতে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদানের পক্ষে রায় হয়।
প্রবাসীদের দাবির মুখে ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর পর তৎকালীন এটিএম শামসুল হুদা কমিশন প্র্রথমবারের মত প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে উদ্যোগী হয়। তখনকার দুই নির্বাচন কমিশনার ছুহুল হোসাইন এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসাইন এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য যুক্তরাজ্য সফরও করেন।
২০১৪ সালে রকীব উদ্দিন কমিশনও প্রবাসীদের ভোটার করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু সে উদ্যোগও বেশিদূর এগোয় নি বলে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাংলাদেশীদের অভিযোগ।
দুই দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার পক্ষে জোরালো আশ্বাস দিলেও এত বছরেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় নি।
যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা মনে করছেন তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি দীর্ঘসূত্রিতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে রয়েছে। ফলে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের মতে এবারও একাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত পোস্টাল ব্যালটে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা