স্বদেশী ছোঁয়ায় আনন্দ আয়োজনে বিসিসিডিআই-এর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান
এ্যন্থনী পিউস গমেজ, ভার্জিনিয়া
পহেলা বৈশাখ মানেই আনন্দ-উচ্ছাসের ছোঁয়ায় নতুন প্রত্যাশা আর স্বপ্নের আলোয় নতুনকে বরণ করে নেয়ার আনন্দ আয়োজন। পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীর সবচেয়ে উৎসবমুখর অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যের আবাহনে নিজেদের মিশিয়ে দিয়ে নতুন জাগরণে জেগে উঠার দিন, প্রানের স্পন্দনে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়ার দিন। আর এই বর্ষবরণ উৎসব যেমনি দেশের মাটিতে তেমনি প্রবাসের অঙ্গনেও আনন্দ হিল্লোলে আন্দোলিত করে প্রতিটি বাঙ্গালীর হ্রদয়। তাইতো পহেলা বৈশাখ বা নব বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী বাঙ্গালীরাও মেতে উঠে আনন্দ উচ্ছাসের বন্যায়। আর এই ঐতিহ্যবাহী আনন্দ উৎসবের ধারাবাহিকতায় যোগ দিয়ে এক বর্ণীল বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন- বিসিসিডিআই (বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিটি ডিভালপমেন্ট ইন্ক )-এর বাংলা স্কুল।
বিসিসিডিআই বাংলা স্কুল আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি যাদের প্রাঞ্জল ও সাবলীল সঞ্চালনায় প্রানবন্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তার হলেন- জনাব শামীম চৌধুরী, শতরুপা বড়ুয়া এবং লিজা বড়ুয়া। প্রথমেই লিজা বড়ুয়া সবাইকে এই বৈশাখী আয়োজনে সবাইকে স্বাগতম এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ করেন। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে বাংলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশ এবং যুক্ত্রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সমবেতভাবে এবং সবাই দাঁড়িয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। বিসিসিডিআই বাংলা স্কুল আয়োজিত এই নব বর্ষবরন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন, ডঃ ভ্যালেরি এ্যান টেইলর, যিনি বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্থ/পঙ্গু অসহায় মানুষের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য তার প্রতিষ্ঠিত সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান “সি আর পি” (সেন্টার ফর দা রিহ্যাবিলিট্যাশন এন্ড প্যারালাইজড)- এর মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ চার দশকেরও বেশী সময় ধরে। তাকে “বাংলাদেশের মাদার তেরেসা” হিসেবে গন্য করা হয় বাংলাদেশে আর্তমানবতার উদ্দেশ্যে তার নিবেদিতপ্রান সেবাকর্মের জন্য।
এরপর শুরু হয় আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার প্রথম অনুষ্ঠান… একটি দলীয় নৃ্ত্য। ভারতের একসময়ের জনপ্রিয় ভিন্ন ধারার গায়ক ভূপেন হাজারিকার গান এবং দুই-বাংলার গানের জগতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তিনটি গানের অংশবিশেষের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয় দলীয় নৃত্য- “অরুণ প্রাতের তরুণদল”। এই পরিবেশনায় বাংলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের বন্ধুদের নৃত্যের ঝংকারে মেতে উঠেছিল মঞ্চ এবং আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল শ্রোতা-দর্শকদের মন। যারা তাদের চমৎকার পরিবেশনায় সবাইকে মুগ্ধ করেন , তারা হলেনঃ- অদ্রিতা, ইশাৎ, মোহতাসিনুর, মুস্তাবিনুর, প্রিয়াংকা, রীমা, রনি এবং সামারা। নৃত্যের কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন ডঃ সোমা বোস।
এর পরপরই একক নৃত্য পরিবেশন করে বাংলা স্কুলের ছাত্রী নোরা। আর একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন- মিঃ ক্লেমেন্ট স্বপন গমেজ, কালাচাদ সরকার, রুমা ভৌমিক, তনুশ্রী দত্ত এবং শারমিন শিপু টগর। দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন- কালাচাদ সরকার এবং বুলবুল ইসলাম।
গানের ঝংকার শেষ হতেই শুরু হয় আবার নৃত্যের ঝংকার… “আজি ঝরো ঝরো” গানটির সাথে নৃত্য পরিবেশন করে মুর্ছনা বড়ুয়া, ছিল চমৎকার পরিবেশনা।
অতঃপর দর্শকদের মন জয় করে, নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করে বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা মঞ্চে নিয়ে আসে গ্রামীন জনপদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার উপড় এক অনবদ্য পরিবেশনা… “এই অপরুপ বাংলা আমার”। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা এবং কিশোর-কিশোরীরা তাদের পরিবেশনায় মুগ্ধ করে দেয় সবাইকে এবং ডেকে নিয়ে যায় এক নস্টালজিক ভাবনায়, নিয়ে যায় পেছনে ফেলে আসা বাংলার সেইসব ঐতিহ্য আর কৃষ্টির স্পর্শে, যা লুকিয়ে ছিল আমাদের সবার অন্তরের গভীরে স্মৃতির ভাঁজে। এপর্বের কোরিওগ্রাফীতে ছিলেন বৃষ্টি আর যারা এই পরিবেশনায় অংশগ্রহন করে, তারা হলঃ জুবিন, তানজিন, ফরহাদ, সারিবা হোসেন, আদিত্য বড়ুয়া, আনন্দী বড়ুয়া, আব্রার মাহবুব, নাবিল হাসান অনন্ত, এলিনা খান, হ্রিদিতা চৌধুরী, সামিয়ান খান, রুদ্র দত্ত, ধ্রুব দত্ত এবং সাঈদ হোসেন।
অনুষ্ঠানের এই অবসরে বিসিসিডিআই আয়োজিত বৈশাখী অনুষ্ঠানের স্পন্সরদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দর্শকদের সাথে। গ্র্যান্ড স্পন্সর- সি,ই,ও নাজির ইরফান ( টেগরা আই, টি, সল্যুসন) গোল্ড স্পনসর- রিয়েল্টর আনিস খান (রিম্যাক্স), সিল্ভার স্পন্সর- ডঃ হীপ ফ্যাম এবং ডঃ ইয়ং চো (ফরেষ্ট ফ্যামিলি ডেন্টিষ্ট্রি)। এছারাও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় বাংলা স্কুলের অন্যতম হিতাকাংখী বোস ল’ ফার্মের কর্ণধার, এ্যটর্নি সুদীপ বোসকে।
অনুষ্ঠানের পরবর্তী আকর্ষন ছিল রোকেয়া জাহান হাসির একক নৃত্য পরিবেশনা। তার চমৎকার নৃত্যশৈলীর অনবদ্য পরিবেশনায় সবাইকে মুগ্ধ করেন তিনি।
অতঃপর বিসিসিডিআই-এর বর্তমান সভাপতি, মিঃ সঞ্জয় বড়ুয়া তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে আয়োজনে যোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। এছাড়া তিনি উপস্থিত দর্শকদের কাছে বিসিসিডিয়াই-এর সকল পরিচালক ও কর্মকর্তাদের মঞ্চে আহবান করে তাদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন।
এরপরই মঞ্চে আসেন ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার স্বনামধন্য অন্যতম বৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, “একতারা” নাট্য পরিবারের শিল্পীবৃন্দ । “একতারা” বিগত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে দর্শকদের উপহার দিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যভিত্তিক নাটক । এই অনুষ্ঠানে পরিবেশনার জ্ন্য তারা “ময়মনসিংহ গীতি কবিতা” থেকে বেছে নিয়েছেন দুইটি জনপ্রিয় লোকগাথা – “সোনাই মাধব” এবং “চন্দ্রাবতী”। তারা এই পালা দু’টির সংমিশ্রনে স্বল্প পরিসরে অনবদ্যভাবে পরিবেশন করেছেন, যা দর্শকদের বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছে। পরিচালনা ও নির্দেশনায় ছিলেন একতারা নাট্য পরিবারের জনাব শেখ মিলন মাওলা।
অতঃপর বাংলা স্কুল ডান্স একাডেমীর পরিচালক, সবার পরিচিত এবং সবার প্রিয় বনানী চৌধুরীর পরিচালনায় “আনন্দধাম” নৃত্যানুষ্ঠানে দলীয় নৃত্য নিয়ে মঞ্চে আসে বাংলা স্কুল ডান্স একাডেমীর শিল্পীরা। তাদের দৃষ্টিনন্দন নৃত্য পরিবেশনায় সবাই মুগ্ধ হয়ে করতালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানায়।
এবার বিসিসিডিআই-এর প্রাক্তন সভাপতি, অনুষ্ঠানের অন্যতম সঞ্চালক জনাব শামীম চৌধুর মঞ্চে আহবান করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি… বাংলাদেশের দুঃস্থ-পঙ্গু মানুষদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সি,আর,পি-এর প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালিকা ডঃ ভ্যালেরী এ্যান টেইলরকে। জনাব শামীম চৌধুরী পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় তাকে “বাংলাদেশের মাদার তেরেসা” নামে তিনি সমাধিক পরিচিত বলে তিনি দর্শকদের কাছে উল্লেখ করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডঃ ভ্যালেরী এ্যান টেইলর সবাইকে তার ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বভাবসুলভ নম্রতার সাথে সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং বাংলাদেশে ভ্রমনকালে ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকাবাসীদের ঢাকায় তার কার্যক্রম দেখে আসার বিনীত আমন্ত্রন জানান। এছাড়া বাংলাদেশের অসহায় পক্ষাঘাতগ্রস্থ,পঙ্গু, দুস্থ লোকদের সাহায্য করার জন্য তিনি সবাইকে আন্তরিক অনুরোধ জানান। প্রধান অতিথির সম্মানার্থে এবং তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য তাকে মঞ্চে আসীন করা হয় এবং রোকেয়া জাহান হাসির চমৎকার নৃত্যের মধ্য দিয়ে তাকে বরণ করে, অভিনন্দন জানিয়ে বিসিসিডিআই-এর পক্ষ থেকে তার প্রতি সম্মান ও ভালবাসার চিহ্নস্বরুপ তাকে একগুচ্ছ ফুল উপহার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানের এই অংশে নাসের চৌধুরীর পরিচালনায় আবার জমে উঠে সঙ্গীতের আসর। মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য আসেন বাংলা স্কুল মিউজিক একাডামীর সদস্যবৃন্দঃ সুসন্তিকা, ফারহান, সাইদ, প্রভা, তানিশা, অনিতা, নোরা, ফারিয়েল, অংকিতা, আদিত্য, অপ্সরা, আনন্দী, অবন্তী, বাধন, ফারজান, তাশনুভা, তাজ, সুশময়, স্বপ্নিল, সুষমী, অতষী, সৃজন, বিজন, আঞ্জুম, তানিশা, এ্যম্বার, এমা, দিবিয়া, কৌশিক, প্রিয়াংকা, রনিতা, অদ্রিতা, মাহেক, ওয়াদিয়া ও শ্রেয়সী।
এছাড়া অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে মঞ্চে আহবান করা হয় স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার, নৃত্যপরিচালক মিসেস ওয়ার্দা রিহাবকে এবং তার অবদানের জন্য তাকে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। নৃত্যশিল্পী-কোরিওগ্রাফার ওয়ার্দা রিহাব উল্লেখ করেন যে, প্রবাসের মাটিতে এমনিভাবে বাংলাদেশের কৃষ্টী, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রবাসী বাঙ্গালীরা তাদের বুকের গভীরে এমনিভাবে সজীব রেখেছেন দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল ওয়াশিংটনের সুপরিচিত বাঙ্গালী-আমেরিকান ব্যান্ড গ্রুপ- “শ্যাডো ব্যান্ডে”র সঙ্গীত পরিবেশন। তাদের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে মন মাতানো গানে তারা সবাইকে মাতিয়ে তোলেন।
ঊল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জায় ছিলেন জনাব হারুনুর রশীদ, জনাব ইফতেখার আরিফ এবং জনাব এহসান আলম। শব্দনিয়ন্ত্রন ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন রবিউল ইসলাম শিশির।
অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল নানা বাহারী স্বদেশী খাবারের স্টল, রকমারী মনোহারী পন্যের স্টল, নানা রঙ্গের পোশাক এবং জুয়েলারীর স্টল এবং সামাজিক-ব্যবসায়িক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর স্টল। আরো ছিল হাতে মেহেদী লাগানোর স্টল, যেখানে অনেক ছোট ছোট মেয়েদের হাত রঙ্গীন হয়ে উঠে মেহেদির রঙ্গে।
অবশেষে বিসিসিডিআই-এর সাংস্কৃতিক সম্পাদক দীপক বড়ুয়া বিসিসিডিআই বাংলা স্কুলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে এই আয়োজনকে সফল করার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আয়োজিত বাংলা নব বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষনা করেন।