স্বাধীনতা এবং মওলানা ভাসানী
শাহ আহমদ রেজা:
বিজয়ের মাসে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। কারণ স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তার ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার একজন প্রধান নির্মাতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে নিজের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী (মুসলিম) লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন চাইতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী— যেখানে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ মতো প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল।

নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নির্ধারণের জন্য ৯ জানুয়ারি তাঁর উদ্যোগে সন্তোষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সম্মেলন। এই সম্মেলন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরো একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানমুখে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়ার উচিত এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেওয়া। নিজের ছেলের মতো শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তাঁর উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন— যার অর্থ, ওইদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ী হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ভারতবিরোধী পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে দেয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন ও সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাঁকে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তাঁর সে দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। মওলানা ভাসানী শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রাম করে যাননি, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও নেতা ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও দুজনের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন, পরামর্শের জন্য হাজির হয়েছেন সন্তোষে। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীও তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন। এভাবেই একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন মওলানা ভাসানী।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
সূত্র:হক কথা