স্বাস্থ্যকর এবং পরিচ্ছন্ন শহরের পর এবার বিশ্বে নির্মল বাতাসের শহর রাজশাহী

689

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা (পিএম ১০) দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী শহর। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজশাহীর বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা পিএম ১০ (১০ মাইক্রোমিটার) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম। এটা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে চলতি বছর দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রামে। দুই বছর আগেও এ শহরে ক্ষুদ্র ধূলিকণা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ৭০ মাইক্রোগ্রাম। এটি প্রায় এখন অর্ধেক হয়ে দাঁড়ায় ৩৭ মাইক্রোগ্রামে।

18713372

স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে ইতিমধ্যে দেশের সব শহরের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী। আর বিশ্বের এ সাফল্য কিভাবে সম্ভব হলো এর কারণ জানতে একটি জাতীয় পত্রিকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরও চমকপ্রদ তথ্য। মূলত সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনে নগর উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা ও জিরো সয়েল প্রকল্প গ্রহণের কারণেই এ সাফল্য। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগে শহরের রাস্তা ও ফুটপাথ বাদে অবশিষ্ট ফাঁকা জায়গা ঢেকে দিতে জিরো সয়েল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রাসিক। ফলে সবুজে ঢেকে যায় গ্রীনসিটি খ্যাত রাজশাহী নগরী। এরই মধ্যে সবুজ হয়েছে শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তার সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপ। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক জানান, ওই প্রকল্পের আওতায় পুরো নগরীর সড়ক বিভাজক আসে সবুজায়নের আওতায়। ইতিমধ্যে নগররের বেশিরভাগ অংশের সড়ক সুবজায়ন ও সৌন্দর্য্য বর্ধনের আওতায় এসেছে। তিনি বলেন, নগরীর প্রধান সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপে ৩৫০টি পামগাছ লাগানো হয়েছে। ২০ ফুট অন্তর লাগানো হয়েছে এসব গাছ। এর ভেতর লাগানো হয়েছে রঙ্গন, কাঠ করবি, চেরি ও এ্যালামুন্ডা। সব নিচে লাগানো হয়েছে সবুজ হেজ। এরপর কাঠ ও বাঁশের আদলে তৈরি করা হয়েছে কনক্রিটের বেড়া। সব মিলিয়ে এখন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে পুরো নগরী। পুরো বিষয়টি দেখভাল করছে প্রায় অর্ধশত শ্রমিক। নগরীর সবুজ ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা। জিরো সয়েল প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব ঠেকাতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাসিক। এর ফলে বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষুদ্র ধুলিকণা মুক্ত হয়েছে নগরী। এর পাশাপাশি পুরো নগরীর সৌন্দর্য্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের আধুনিক বিভিন্ন শহর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তারা এ প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এ নিয়ে কথা হয়, রাসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম উল আযীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজশাহী নগরীকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে রাসিক। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় তারা সবুজায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন হচ্ছে জিরো সয়েল প্রকল্প। এর আওতায় পর্যায়ক্রমে পুরো নগরী সবুজে ঢেকে ফেলা হবে বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, রাজশাহী নগরীকে পরিচ্ছন্ন করতে জিরোসয়েল প্রকল্পটি ছিল সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তার পরিকল্পাতেই রাজশাহী নগরী হয়ে উঠেছে এখন বিশে^র পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর নগরীর অন্যতম শহর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের পরিচালক উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক এম. মনজুর হোসেন বলেন, রাজশাহীতে বর্তমানে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চলাচলের কারণে ডিজেলচালিত যানবাহন শহরে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

রাজশাহীর বাতাসে ক্ষতিকারণ ভাসমান কণা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি। তিনি আরও বলেন, রাজশাহী নগরের পদ্মা নদীর পরিত্যক্ত পাড়ে বর্তমানে পরিকল্পিত পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার টাইলস দিয়ে হাঁটার পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এটি এখন পদ্মার নির্মল বাতাসের একটি উৎস। এসব জায়গা থেকে আর ধুলোবালি ওড়ে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুলতান উল ইসলাম বলেন, রাজশাহী নগরের চারদিকে যে সবুজ বেস্টনি গড়ে তোলা হয়েছে, পাশে পদ্মা নদীর চরও সবুজ ঘাস ও কাশবনে ছেয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ফসলও হচ্ছে। এ কারণে আগে যে পরিমাণ ধূলিঝড় দেখা যেত, এখন আর দেখা যায় না। এদিকে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের যে ১০টি শহরে গত দুই বছরে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা কমেছে, এর মধ্যে রাজশাহীতে কমার হার সবচেয়ে বেশি। ইটভাঁটির চিমনির উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়া, বনায়ন, রাস্তার পাশের ফুটপাথ কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেয়া, ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার বহুল ব্যবহার, ডিজেলচালিত যানবাহন চলাচলে কড়াকড়ি- এসবই রাজশাহীর বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ধুলি ধুসর রাজশাহীকে গ্রীনসিটি, ক্লিন সিটি’ তৈরির স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তার সময়কালে নেয়া হয় নানা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে ধুলিঝড় ছিল এই শহরের একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এই নগরীর পরিবেশ বিশেষত বায়ু দূষণ ছিল বড় সমস্যা। এ নিয়ে কাজ শুরু করেন লিটন। তিনি বলেন, খায়রুজ্জামান লিটনের একটি ভিশন ছিল। এজন্য তিনি নগর বনায়নের উদ্যোগ নেন। যার মূলে ছিল জিরো সয়েল প্রকল্প। শহরকে সবুজায়নের প্রচেষ্টা ছিল তার প্রথম থেকেই।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.