“হৃদয়বীণা”- একটি দুঃস্থ শিশুকল্যান আহবান
এ্যন্থনী পিউস গমেজ, ওয়াসিংটন ডিসি : গত ১৩ই নভেম্বর, ২০১৬, রোজ রবিবার অপরাহ্ন দুই ঘটিকায় মেরীল্যান্ডের দ্যাস জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ওয়াশিংটনের নতুন উদ্যোগ ““হৃদয়বীণা”-র প্রথম এবং বিশেষ আলোচনা সভা। সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠকদের উপস্থিতিতে অত্যন্ত ফলপ্রসু আলোচনার মধ্য দিয়ে ইতিবাচক সাড়ায় আরও গভীরভাবে অনুপ্রানিত হয়ে শুভ যাত্রা শুরু হলো “হৃদয়বীণা”-র। এটি মূলতঃ কোন প্রাতিষ্ঠানিত অবকাঠামো নিয়ে কোন ফর্মাল সংগঠন নয়, বরং মানবকল্যান আহবান বা দুঃস্থ্য শিশুকল্যান আহবান! এর মূখ্য উদ্দেশ্য হলো শিশুকল্যান বা অবহেলিত তৃনমূল পর্যায়ের ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য এগিয়ে আসা এবং এই মানবিক মহতী উদ্যোগে সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে এক মানবিক স্বপ্ন। এই মানবিক স্বপ্নকে সফল করে শিশুকল্যান কাজে অংশগ্রহনের জন্য সমাজের সবার প্রতি উদাত্ত আহবান!
নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতী উদ্যোগ! ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দেবার চাইতে বড় দয়ার কাজ আর কী হতে পারে? যে শিশু জন্ম নিয়ে ক্ষুধার কষ্টে দিন কাটাতে হয়, যে শিশু-কিশোরদের দু’মুঠো খাবারের আশায় স্কুলে যেতে হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী দেশ হয়েও যেখানে প্রাচর্য্যের উচ্ছিষ্টটুকু এদের ভাগ্যে জোটেনা, যেখানে আমরা এদের কষ্ট দেখেও না দেখার ভান করে ডুবে থাকি নিজস্ব আরাম-আয়েসের জীবনধারায়, যেখানে আমাদের সন্তানদের মুখের হাসি দেখার জন্য, তাদের পরিতৃপ্তির জন্য ব্যস্ত থাকি অবিরত, সেখানে অবহেলিত ক্ষুধার্ত শিশুগুলোর বেদনাতুর মুখগুলো একবারও ভেসে ওঠেনা আমাদের মনে। নিজ সন্তানদের তৃপ্তিতে আমাদের মুখে যে হাসি ফুটে অঠে, সেখানে হারিয়ে জায় ক্ষুধার্ত শিশুগুলোর ক্ষুধার যন্ত্রনা। এই সুখ সুখ অনুভূতির মাঝে ঐ অবহেলিত, ক্ষুধার্ত শিশুদের কথা ভাবে দেখার অবসর আমাদের কোথায়? আমাদের চিন্তা-চেতনায় ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েগুলোর কষ্ট নাড়া দেয় না প্রায়শঃ। তবে নাড়া দিয়েছে ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার সবার পরিচিত দুইজন মানুষকে- শিল্পী রুমা ভৌমিক ও ডঃ সোমা বোসকে। তাদের চেতনায় ক্ষুধার্ত শিশুগুলোর কষ্ট আঘাত করেছে বলেই তারা উদ্যোগ নিয়েছেন এই অবহেলিত শিশুদের মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য, তাদের কষ্টে সাধ্যানুসারে সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য এবং তারা অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করছেন তাদের চারপাশের, সমাজের বিবেকবান মানুষগুলোকেও, যাতে এই মহতী উদ্যোগে সবাই অংশীদার হতে পারে, যাতে আরও বেশী সংখ্যক শিশুদের ক্ষুধা নিবারন হয়, ওদের মুখে হাসি ফুটে উঠে। সবাইকে নিয়ে পথচলার এই উদ্যোগ ভূয়সী প্রসংশার দাবীদার, কেননা সবাই মিলে অনেক বড় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব, কিন্তু এককভাবে সীমাবদ্ধতা থেকেই যাবে। সমাজের সুধীজন এবং শিল্পীরা মিলে এই মহতী উদ্যোগ সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে এটা হবে একটা দৃষ্টান্ত এবং মানুষের চেতনায় মহতী কাজে অংশ নেয়ার অনুপ্রেরণা।
সভার যারা উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশগ্রহন করেছেন, পরামর্শ দিয়ে এই প্রচেষ্টাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য উৎসাহি করেছে, যারা সক্রিয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে উদ্যোক্তাদের মানসিক শক্তিকে আরো জোরদার করেছেন, তারা হলেনঃ
রুমা ভৌমিক, ডঃ সোমা বোস, এডভোকেট সুদীপ বোস, জনাব ওয়াহেদ হুসেইনি, সুরঞ্জন দত্ত, ছায়া দত্ত, জনাব শামীম চৌধুরী, মৃদুলা মিত্র ব্যায়াস, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, শম্পা বণিক, বিশ্বনাথ দত্ত, কৃষ্ণা দত্ত, ইফতেখার আরিফ এবং অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
স্বাগত বক্তব্যে রুমা ভৌমিক তাদের এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যের উপর আলোকপাত করেএই মহতী কর্মপ্রয়াসে সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই দেশের নাগরিক হিসেবে এখানকার দুঃস্থ্য ক্ষধার্ত শিশুদের সাহাজ্য করা আমদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।জাতীয়ভাবে শিশুদের জন্য কর্মরত “No Kid Hungry Campaign”-এর সাথে একাত্বতা ঘোষনা করে “““হৃদয়বীণা” তাদের মাধ্যমে এই শিশুদের জন্য এগিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর- প্রয়োজন সবার সক্রিয় সহযোগিতা।
“হৃদয়বীণা”র অন্য উদ্যোক্তা, ডঃ সোমা বোস তার বক্তব্যে উল্লেখ করে বলেন যে, এখন থেকে “হৃদয়বীণা”র প্রতিটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ এইসব দুঃস্থ্য ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য দান করা হবে এবং শিল্পীদের অংশগ্রহনে এটা হবে শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক কল্যান কাজে এগিয়ে আসা।
এছাড়াওঅনুষ্ঠানেবক্তব্যরাখেনওয়াশিংটনমেট্রোএলাকারস্বনামধন্য এ্যটর্নি মিঃ সুদীপ বোস। তিনি তার মূল্যবান বক্তব্যে এদেশের নাগরিক হিসেবে এখানকার স্থানীয় দুঃস্থদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, আমরা আমাদের স্বদেশকে ভালবাসি এবং দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্ত একইভাবে এদেশের নাগরিক হিসেবে এদেশের প্রতিও আমাদের একটি বিরাট দায়িত্ব রয়ে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এদেশই তাদের মাতৃভূমি এবং এদেশই তাদের ভবিষ্যৎ এবং তারা এদেশের মূলধারার অংশ। আমরা যারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি, আমাদের সমস্ত প্রাপ্তির উৎসও এই দেশ। তাই এদেশের নাগরিক হিসেবে এদেশের দুঃস্থদের জন্য এগিয়ে আসা আমাদের জন্য হবে একটি সময়োপযী ও যথাযথ মানবিক পদক্ষেপ। তিনি সবাইকে “হৃদয়বীণা”র এই মহতী কাজে এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাকী অতিথিবৃন্দ তাদের বক্তব্যে একই সুরে এই দুঃস্থ্য শিশুদের কল্যানে এগিয়ে আসার জন্য তাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করে অন্নান্য সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। সবার বক্তব্যে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, এটি একটি মহতী উদ্যোগ এবং এধরনের মানবকল্যানমূলক কাজে সহযোগিতা করার জন্য সবাই প্রস্তুত!।
এছাড়াও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে উল্লেখ করে সবাইকে দারিদ্রতাক্লিষ্ট মানুষদের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য, সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু ঠিকমত খাবার খেতে পায়না, ১৩ মিলিয়ন শিশু প্রতিনিয়ত ক্ষুধার সাথে সংগ্রাম করে চলেছে, চার জন শিক্ষকের মাঝে তিন জন শিক্ষক জানেন যে তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিয়মিত স্কুলে আসে। আর যে সব দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে প্রাতঃরাস করে থাকে, তারা স্কুর বাদ দেয়ার কথা চিন্তা করেনা এই জন্য যে স্কুলে গেলে তাদের আহার মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ মিলিয়ন দারিদ্রতাক্লিষ্ট লোক জানেন না তাদের পরের আহার কোথা থেকে আসবে এবং তাদের মাঝে ১৩ মিলিয়নই হচ্ছে শিশু। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এ পরিস্থিতি আজও এদেশে বিদ্যমান।
হৃদয়বীণার উদ্যোক্তারা এই মহতী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছর ৬ই মে,২০১৭ একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার (“হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল”) আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। আর এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা থেকে সংগৃহীত অর্থ এই সব দুঃস্থ্য শিশুদের কল্যানে দান করা হবে বলে জানিয়েছে রুমা ভৌমিক ও ডঃ সোমা বোস।
অতঃপর সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সভার সমাপ্তি করা হয়। সবাই এই মহতী উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে বিদায় গ্রহন করে… সবার মনেই একটি উপলব্ধি কাজ করেছে… এমনি মহতী মানবকল্যানমূলক কাজে অংশগ্রহন করাটা শুধু আমাদের দায়িত্বই নয়, এটা আমাদের একটি অনন্য সুযোগ দেবার জন্য। সারা জীবন আমরা যারা শুধু নিয়ে তৃপ্ত হয়েছি, এবার আমাদের দেবার পালা… এবার দেবার আনন্দে তৃপ্তি লাভ করার অনুপম অভিজ্ঞতার প্রতিক্ষায় সবাই অপেক্ষমাণ!যদি আমাদের চেতনায় জাগরণ এসে থাকে, যদি আমাদের বোধোদয় হয়ে থাকে, যদি আমরা বিশ্বাস করি আমাদের এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, যদি অন্তরে উপলব্ধি করে থাকি রবী ঠাকুরের গানের এই কথাগুলো……
“আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি- আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী- সবদিতে হবে”…………..
তবে দুঃস্থদের সেবাই হোক আমাদের এইমহতীউদ্যোগেরঅনুপ্রেরণা, আমাদের এইপ্রয়াসের আনন্দের উৎস! আসুন আমরা দেবার আনন্দে, সেবার আনন্দে গৌরবান্বিত হই আমাদের সৃষ্টিকর্তার নামে।