১৫৪ জন ‘জিপি’, সংবিধানের কোথায়, প্রশ্ন কামালের
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নতুন নামকরণ করেছেন।
শনিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবী মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন এ নামকরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৪ জনকে এমপি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করা এমপি হয়ে বলবেন আমি এমপি, আপনাকে কে নির্বাচিত করেছে? এই ১৫৪ জনের জন্য অভিধানে একটা নতুন শব্দ বের করতে হবে। এখন থেকে বলতে হবে জিপি (জি তে ঘোষিত, পি প্রতিনিধি)। আসুন আমরা এমপি থেকে জিপি ডাকা শুরু করি। ঘোষণার কত জোর আছে, ঘোষণা করে দিলাম এমপি হয়ে গেল। ঘোষণা করে দিলাম মন্ত্রী হয়ে গেল। এই ঘোষণার শক্তিটা আসে কোথা থেকে? সংবিধানের কোথায় আছে যে, ঘোষণা দিলাম, এমপি হয়ে গেল?’
প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘আর ঘোষিত এমপিদের গেজেট বা এগুলোর ঘোষণা কে ছেপে দেবে? আমাকে গেজেট রুলস দেখতে হবে। সরকারি প্রেসের যেসব কাগজ নষ্ট করেছে, এর পয়সা তাদের ফেরত দিতে হবে। গেজেট কিসের গেজেট? গেজেট তো বাই অথরিটি অব ল, সেটা গেজেটে যাবে। গেজেটে কী ছাপানো যায়, তারও আইন আছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার শুধু সংবিধান, সংবিধান করেন। এসব শুনলে আমার হাসি পাই। তোমাদের ক্ষমতায় থাকাইতো অসাংবিধানিক। প্রত্যেক মুহূর্তে তোমরা সংবিধান ভঙ্গ করছো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংবিধান ভঙ্গ করছো।’
গণফোরাম সভাপতি বলেন, ‘ইলেকশন কবে হয়েছিল? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। আজকে ২০১৮ সাল, ৫ বছরের জন্যতো তোমরা নির্বাচিত হওনি। নামকাওয়াস্তে নির্বাচন, যেটা তোমরাও বলেছিলে, সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য, সেটা করেই তোমরা ৫ বছর চালিয়েছ। তারপরও সংবিধান দেখাচ্ছো? আমিতো মনে করি, সংবিধানের কপি এদের সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। খুলে দেখ কি আছে সেখানে?’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের প্রথম লাইনে লেখা আছে সংবিধান। এরপরে কোন লাইন, তারা পড়েছে বলে আমার মনে হয় না। তোমরা পড়লেই বুঝতে পারবে, নিজেরা কত বিধান ভঙ্গ করছো।’
কামাল হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রী যাদের বলা হচ্ছে, তারা কারা? উপদেষ্টা বলা হচ্ছে, এরা কারা? তারপর মেম্বার (সংসদ সদস্য) বলা হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ, ১৫৪ জন মনোনীত, তারা বলে এমপি। এই এমপি আসলে মনোনীত প্রার্থী। এমপি মানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট, কিন্তু, তাদেরকে কিভাবে বলব আমরা? আমি বলি, তাদের একটু লজ্জাবোধ ফিরে আসুক। আমাদের যারা এমপি-মন্ত্রী আছেন, তাদের একটু লজ্জাবোধ ফিরে আসুক।’
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের একটা দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। বারকে সব সময় রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। আপনারা রাজনীতি করবেন, সবই ঠিক আছে। কিন্তু, বারকে রাজনীতিকরণ করে ফেলবেন না। বারের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা উচিত। বারের নেতা হিসেবে দলীয় নেতা পরিচয় দেয়া উচিত না, আমি কখনও দেইনি। দলীয়ভাবে বারকে ব্যবহার করা যাবে না। এখানে আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য কাজ করবে।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বার অ্যাসোসিয়েশন দায়িত্ব সবাইকে আইন সম্পর্কে অবগত করা। সরকারকে ডাকতে পারেন (সংবিধান নিয়ে) ট্রেনিংয়ের জন্য। আমি তাদের উদ্দেশে সারাদিন লেকচার দিতে পারি। আইন কী আছে দেখ। কিন্তু, ওরা এতো অহঙ্কারী যে, তারা বলবে আমরা কি কম জানি নাকি? কিন্তু, তোমরাতো খুব বেশি জান। একটু আইন আমরা পাঠিয়ে দেই, দাগ দিয়ে দিয়ে যে তোমরা কিভাবে এগুলো দাবি কর (এমপি)।’
তিনি বলেন, ‘এরা এমপি কিভাবে, উইথ আউট ইলেকশনে আমি বুঝতে পারি না? পার্লামেন্টের একটা বাক্য আছে না? এদের কে ইলেক্ট করেছে? ঘোষণা করা এমপি হতে পারি কিনা? এটাতো এবিসিডি? আমি আইন পড়াতাম, ফাস্ট ইয়ারে ছাত্রদের যদি বলা হয়, কেউ যদি ইলেক্টেড না হয়ে যদি বলে এমপি, তাহলে ছাত্ররা হাসবে। বলেন কি স্যার? এদেরকে আইন পড়াতে হবে। চলেন আমরা পড়াই।’
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন সবাইকে লজ্জা দিক। আদমের সন্তান, একদম জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে লজ্জাবোধও থাকা দরকার। আইন-কানুন না মেনে যা-তা করে নির্লজ্জভাবে। আমি এদেরকে মাননীয় বা মহামান্য বলা অসম্ভব মনে করি। এদেরকে ডিস অনারেবল বলতে হয়। এরা মানুষের সঙ্গে ভাওতাবাজি করার চাকরি নিয়েছে।’
নির্বাচন বয়কট করবে না ঐক্যফ্রন্ট
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা অবাধ নিরাপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমি একদম সবাইকে হাত জোর করে বলব, নির্বাচন বয়কট-টয়কট একদম আমরা করব না। ওরা যত কিছুই করুক না কেন আমরা নির্বাচন বয়কট করব না। একথা আমরা কেউ বলবও না। একবার বয়কট করাই জাতি অনেক ভোগান্তি পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে কোর্টে মামলা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ কোর্টে বলেছিল— এটা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার নির্বাচন, দ্রুত আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তখন কোর্ট আমাকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে ডেকেছিলেন। কোর্ট আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ওই নির্বাচন নিয়ে। তখন বলেছিলাম, এক কথায় বললে তো বলা যায়, এটা কোনো নির্বাচন না। কিন্তু, তারা যখন বলছে পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন করেছে, দ্রুত আরেকটি নির্বাচন করবে। তাই সুযোগ দেয়া উচিত।’
প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘এখন কথা হচ্ছে, দ্রুত নির্বাচন মানে কি ৫ বছর? এটা কি বাংলা অভিধানে নতুন করে যুক্ত হওয়া শব্দ। অল্প মানে ৫ বছর। ভাওতাবাজির সীমা থাকা উচিত। ভাওতাবাজিতে তাদের গোল্ড মেডেল দেয়া উচিত। আমরা এখন ভাওতাবাজি থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বেগম জিয়ার মুক্তি চাই। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে পরিত্যক্ত জেলখানায় রেখে নির্বাচন হতে পারে না। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করবেন, অন্যজন জেলখানায় থাকবেন, এটা হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সারা দেশে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলাম, অন্যায় গণগ্রেফতারের কথা বললাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, কাল থেকে আর গ্রেফতার হবে না। কিন্তু, এখনও এই গণগ্রেফতার থামেনি।’
ইভিএম ব্যবহার
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান এই নেতা আরও বলেন, হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইভিএম করছে নির্বাচন কমিশন। খেয়াল-খুশি মতো বাস্তবায়ন করছে সরকার। ইভিএম করতে চাইলে সকলের সঙ্গে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। তা ছাড়া এটা ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।’