৩৯ বছরে বিএনপি : নানা সংকটের আবর্তে দল…

867

মাহমুদ আজহার : ঊনচল্লিশ বছরে পা রাখল দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় জন্ম নেওয়া এ দলটি আজ নানা সংকটের আবর্তে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা আজ বিচারের মুখোমুখি। দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের বেশ কিছুদিন পর কমিটি ঘোষণা হলেও নানা দুর্বলতায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। কাঁচা হাতে করা কমিটি গঠনে হয়েছে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি। সারা দেশে পুরো দলই এখন অগোছালো। বিগত ৫ জানুয়ারি সরকারবিরোধী নিষ্ফল আন্দোলনে নেতা-কর্মীরা মামলা-হামলায় কাবু। দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এ দলের ‘ঢাউস’ কমিটি হলেও নতুন নির্বাচনের আন্দোলনে ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

a15_108203

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সামরিক শাসনামলে ক্ষমতায় থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। তার প্রতিষ্ঠিত এ দলটি নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পাঁচবার দেশ শাসন করেছে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ভাঙনের কবলেও পড়ে দলটি। প্রথমে হুদা-মতিন, দ্বিতীয়বার শাহ আজিজ, তৃতীয়বার কে এম ওবায়দুর রহমান, চতুর্থবার অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, পঞ্চমবার কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং ষষ্ঠবার আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে চরম দুঃসময় নেমে আসে বিএনপিতে। এ সময় দলটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে খোদ খালেদা জিয়ার সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সংগঠনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় এযাত্রায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

BNP-Logo11

এরপর বিপর্যস্ত দলটি ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও দল আজও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। এদিকে দলের ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গত ৩১ আগস্ট বাণী দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বাণীতে তিনি বলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপি বিগত ৩৮ বছরে বারবার সবার অংশগ্রহণমূলক জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণে কাজ করে গেছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের এই প্রিয় দল অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সারা দেশে এখনো সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন আছে। কিন্তু সাংগঠনিক কাঠামো ভঙ্গুর। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তেও দলটি পিছিয়ে পড়েছে। জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতেও বিএনপির অবস্থানকে ভালো চোখে দেখছে না বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। সরকার মোকাবিলায় দলের নেই শক্তিশালী কর্মকৌশল। নেতা-কর্মীদের মধ্যে আস্থাহীনতা চরমে। অতীতের ভুল থেকেও শিক্ষা নিচ্ছে না দলটি। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলছেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন শক্তিশালী। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামোও রয়েছে। তবে সরকারের জুলুম, নির্যাতনসহ নানাভাবে হয়রানি বহুগুণে বেড়ে গেছে। কোনো সভা-সমাবেশও করতে দেওয়া হয় না। এতে স্বাভাবিকভাবেই দল পরিচালনা করতে গিয়ে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। এরই মধ্যে তারেক রহমানকে এক মামলায় সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা শেষ পর্যায়ে। যে কোনো সময় রায় হয়ে যেতে পারে। দলের সিনিয়র সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলার খড়গ ঝুলছে।
এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি মানুষ খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন। তাই আজকে জনগণের সমর্থনের ওপর চাপ দিতে হবে। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য খালেদা জিয়াকে আজ দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিএনপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা হয় অসুস্থ, নাহয় নানা কারণে হতাশায় ভুগছেন। এটা কাটাতে হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তারা অতীতে যেমন জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ভবিষ্যতেও সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়াবেন।’ তিনি বলেন, ‘অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো সংশোধন করতে হবে। ভুলভ্রান্তি বলতে বোঝাচ্ছি, অতীতে অপারেশন ক্লিন হার্ট ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্টের মতো মর্মান্তিক ঘটনা। এর দায় তারা এড়াতে পারে না। এ-জাতীয় ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, জঙ্গিবাদের যেন পুনরুত্থান না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটা জনগণকে নিশ্চিত করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ বিএনপি সমর্থিত এই বুদ্ধিজীবীর মতে, ‘৩৮ বছরে বিএনপি জনগণের মনে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে এটা সত্য। কিন্তু তাদের নেতারা হতাশায় ভুগছেন। দেশের স্বার্থে বিএনপিকে ভালোভাবে বেঁচে থাকা দরকার। মুসলিম লীগ হয়ে কিংবা ভাসানী ন্যাপ হয়ে থাকাটাকে বেঁচে থাকা বলে না। তাই আজকের দিনে তাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, তারা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। তাদের স্থায়ী কমিটির মিটিং হবে প্রতি সপ্তাহে। প্রতিদিন তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলবেন। জনতার মুক্তির জন্য সনদ তৈরি করবেন। তার একটা রূপরেখা আমি আমার খোলা চিঠিতে উল্লেখ করেছি। জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে সুন্দর জীবনযাত্রার। তাহলে দেখা যাবে, হয় তারা ক্ষমতায় থাকবে, নাহয় শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বাংলাদেশের উন্নতিতে যুক্ত হবে। এটাই আমার কামনা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিএনপি এখন বড় সংকটকাল অতিক্রম করছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করে। সংকট হলো, বিএনপির জনসমর্থন আছে। তবে তা দিয়ে সরকারকে নির্বাচনে বাধ্য করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। এখন বিএনপিকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে হলে খুবই নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্যই জামায়াতকে ত্যাগ করে যেসব দলের ইমেজ খুব ভালো, বিশেষ করে বাম দল, গণফোরামসহ প্রগতিশীল দলগুলো নিয়ে বড় জোট গঠন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির পক্ষে সামনে এগোনো খুব কঠিন। অবশ্যই তাদের গতিশীলতার সঙ্গে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। খুব দ্রুততার সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হবে। বিএনপিতে যারা বিদেশি ও বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত অফিস নিয়ে কাজ করেন, তাদের আনুগত্য, দক্ষতা ও নিষ্ঠা বাড়াতে হবে। আওয়ামী লীগের পদক্ষেপের বিপরীতে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে টানা তিন-চার দিনব্যাপী বৈঠক করে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘৩৮ বছরে বিএনপির সাফল্য অনেক। ইতিমধ্যে এ দলটি পাঁচবার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে বৃহত্তম এ দলটি জনসমর্থনে পরিপুষ্ট। এ মুহূর্তে বিএনপি এ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণে নানা সংকটে পড়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন, মামলা হয়েছে। গুম, খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাউন্সিল হয়েছে। কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। এখন আমরা জেলাগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠনে কাজ করছি। আমরা আশা করছি, দল পুনর্গঠনের মধ্য নিয়ে বিএনপি একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে চ্যালেঞ্জ, তা মোকাবিলায় সক্ষম হবে।’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘ইতিহাসের এক চরম মুহূর্তে বিএনপি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর এক দিকে যেমন রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়, আরেক দিকে সংবিধানে যুক্ত হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার এক স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটে। এরপর সংবিধান সংশোধন করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ৩৮ বছরে বিএনপির সাফল্য অনেক। তবে ব্যর্থতাও রয়েছে। আমরাও যে ভুল করিনি তা নয়। তবে আমাদের শাসনকাল ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও সাফল্যমণ্ডিত।’
(বাংলাদেশ প্রতিদিন)

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.